করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বচ্ছতা ও সমন্বয় জরুরি

coronavirus
ছবি: সংগৃহীত

ধন্যবাদ ড. বিজন কুমার শীল ও তার গবেষণা সহযোগী ড. নিহাদ আদনান, ড. মোহাম্মদ রাশেদ জমিরউদ্দিন ও ড. ফিরোজ আহমেদকে। ধন্যবাদ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে। ধন্যবাদ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কর্তৃক করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) টেস্টিং কিট আবিষ্কার করার সংবাদ এই দুঃসময়ে একটি বড় ধরণের ইতিবাচক সংবাদ।

গণস্বাস্থ্য ও সিঙ্গাপুরের একটি দল যৌথ প্রচেষ্টায় আবিষ্কৃত এই কিট উৎপাদনের জন্যে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ আমদানি করতে সরকারের অনুমোদন পেয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই সংবাদ ইতিবাচক।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা মাত্র কাঁচামাল আমদানি করার অনুমোদন পেয়েছি। আমরা প্রায় সাত দিন ধরে অনুমতির অপেক্ষায় ছিলাম। ভালো খবর যে আমরা অনুমতি পেয়েছি।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্য থেকে কাঁচামাল আনতে স্পেশাল প্যাকিং ও কুরিয়ারসহ যাবতীয় প্রসেসিংয়ের জন্য ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগবে। তারপর তা নিয়ে আমরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজ করে দশ দিনের মধ্যে নমুনা কিট তৈরি করতে পারবো। আর ১ মাসের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার কিট বাজারে সরবরাহ করতে পারবো। প্রথম মাসেই ১০ হাজার কিট সরবরাহ করতে পারবো।’

করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিস্তারের সময়ে এক মাস অনেকটা সময়। কিন্তু, এখনকার অবস্থা বিবেচনা করলে একে কেবল আশীর্বাদ বলেই মনে করতে হবে। কেননা, ভাইরাসে আক্রান্তদের পরীক্ষা করার আর কোনও বিকল্প নেই; মহামারির প্রকোপ কমিয়ে আনতে সন্দেহভাজন রোগীদের পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের খুব সাধারণ একটি বার্তা, তা হলো— পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। সব দেশেরই উচিত সন্দেহজনক সব রোগীকে পরীক্ষা করা। চোখ বন্ধ করে থাকলে দেশগুলো এই মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষা ছাড়া সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত করা যাবে না, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না। বিভিন্ন দেশই যে এই কাজে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’

বাংলাদেশ সরকারের হাতে এখন মাত্র ১৫০০ কিট আছে বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, সরকারের হাতে থাকা পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) আছে একই সংখ্যক। অথচ স্বাস্থ্য  অধিদপ্তরের রোগ নিরাময় কেন্দ্র ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এক লাখ পিপিই, পাঁচ লাখ মাস্ক ও সার্জিক্যাল গগলস ও অন্যান্য সরঞ্জাম চেয়েছিলো। কিন্তু, এই বিষয়ে কোনও রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১০ হাজার টেস্টিং কিট ও একই পরিমাণ পিপিইর চালান এখন সিঙ্গাপুরে আছে। এক বা দুদিনের মধ্যে সেগুলো ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

চীন বুধবার ঘোষণা দিয়েছে তারা বাংলাদেশকে ১০ হাজার টেস্টিং কিট, ১৫ হাজার সার্জিক্যাল এন৯৫ রেসপিরেটর, ১০ হাজার মেডিকেল নিরাপত্তামূলক পোশাক ও এক হাজার ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দেবে। এখন সংকটের মাত্রা গভীর হওয়ার পর বৃহস্পতিবার অর্থ বিভাগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে আরও ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে; এই নিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো। এই পরিমাণ অর্থ যথেষ্ট কি না সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এর আগে বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস চিকিৎসা কিংবা নিয়ন্ত্রণে যত টাকা প্রয়োজন হবে তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে সরকার।’

কিন্তু, মনে রাখা দরকার যে কেবল টাকাই এই অবস্থা মোকাবেলার জন্যে যথেষ্ট নয়। খুব শিগগিরই এসব টেস্ট কিট হাতে আসলেও সেগুলো কিভাবে সারা দেশে পরীক্ষার জন্যে ব্যবহার করা হবে তার যে কাঠামো সেটি এখনও অনুপস্থিত। স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হাসপাতাল কিংবা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোকে কিভাবে ব্যবহার করা হবে, কিংবা আলাদা করে কেন্দ্র তৈরি করা হবে কি না সে বিষয়ে কোনও ধারণাই দেওয়া হচ্ছে না।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে হাতে এসব টেস্ট কিট বা পিপিই আসলেই সব সমস্যার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। গত দুই দিনে এই নিয়ে সরকারের তৎপরতা যতটা চোখে পড়ছে তাতে মনে হয় সরকার আগে এই নিয়ে ভাবতেই রাজি ছিলো না। সারা পৃথিবী জুড়ে যখন ভাইরাস নিয়ে যে উদ্বেগ-আশঙ্কা তার প্রেক্ষাপটে সরকারের মনোযোগ যেখানে থাকা দরকার ছিল সেখানে না থাকায় পরিস্থিতি আরও বেশি সংকটের সৃষ্টি করেছে।

সরকারের গৃহীত উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সুস্পষ্ট। করোনাভাইরাসের বিষয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিন তথ্যাদি সরবরাহ করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার যোগ্যতা নিয়ে কোনো রকমের প্রশ্ন না রেখেই একথা বলা দরকার যে, এই ধরণের একটি সংকট বিষয়ে জনগণকে অবহিত করার দায়িত্ব তার নয়। সেই দায়িত্ব সরকারের– আরও সুস্পষ্ট করে বললে রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বিভিন্ন দেশে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার প্রধান বা তার নির্দেশে নিয়োজিত টাস্ক ফোর্সের প্রধান কাঠামোর অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়েই গণমাধ্যমগুলোকে জানাচ্ছেন। তাদের হাতে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্যরাও আছেন। সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার ভেতরে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিক আছে।

বাংলাদেশ সরকারের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ও জানানোর ব্যাপারে কোনো ধরণের সমন্বয় অনুপস্থিত। বৃহস্পতিবারের কয়েকটি উদ্যোগের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্যাদি জানা যাচ্ছে। যেমন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্যে বরাদ্দের বিষয়টি সাংবাদিকরা সংগ্রহ করেছেন মন্ত্রণালয় থেকে।

দুটি কোয়ারেন্টিনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছে এই সংবাদের সূত্র ‘এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’। আমরা বুঝতে পারি যে, এই বিজ্ঞপ্তি সেনা বাহিনীর। সংবাদে বলা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তে কোয়ারেন্টিনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে’। এই উদ্যোগ আগেই নেওয়া দরকার ছিলো কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

গত এক মাসে ধরে বিমানবন্দর দিয়ে আসা মানুষদের পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কেননা, এই বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া ও তার জন্যে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোগ ছিলো না। উপরন্তু, একাধিক মন্ত্রী এমনসব মন্তব্য করেছেন যেগুলো সমস্যার ব্যাপকতার ধারণা দেওয়ার বদলে একে খেলো করেই দেখানো হয়েছে। কিন্তু, এখনও সমন্বিত কাজের অংশ হিসেবে কেনো তা জানানো যাচ্ছে না— সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

একই দিন আমার জানতে পারি যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একথা বলেছেন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায়। সাংবাদিকদের তা জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

সারা দেশে সব ধরনের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এই নির্দেশ দিয়েছে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে। কেনো তা সবার জন্যে একটি নির্দেশনা হিসেবে সরকারিভাবেই ঘোষণা করা হলো না, এ সবের পাশাপাশি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে কিছু উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। যার মধ্যে আছে এই সিদ্ধান্ত কোয়ারেন্টিন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাকাজে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার মাঠ ব্যবহার করা হবে এবং তা করবে সেনাবাহিনী। তিনি জানান, করোনা রোধের প্রস্তুতি হিসেবে স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

এই মহামারির একটা বড় ধাক্কা এসে পড়বে সাধারণ মানুষ, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা বা সেলফ আইসোলেশন যে তাদের পক্ষে কতটা সম্ভব সেটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। সেগুলো মোকাবেলায়, তাদের জন্যে কি ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সরকারের ঘোষিত উদ্যোগে কোনও ইঙ্গিত নেই। যে সব মানুষ ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় থাকেন– যেমন বস্তি, সেখানে কিভাবে পরীক্ষা করা হবে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কিভাবে শনাক্ত করা হবে— সেই বিষয়ে কী ভাবা হচ্ছে তা জানার কোনো সুযোগ নেই। এরকম ব্যক্তিদের জীবন ধারণের জন্যে যা দরকার তার ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী? যারা কল-কারাখানায় কাজ করছেন, বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিষয়ে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন আদৌ কিছু ভাবছেন বা সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কম হবে এমন আশায় যারা এখনও যে কোনো ধরণের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে রাজি নন তারা নিশ্চয় জানেন, এর অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে বাংলাদেশ মুক্ত থাকতে পারবে না। বৈশ্বিক মন্দা এখন প্রায় নিশ্চিত ব্যাপার। ইতোমধ্যেই তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এই প্রভাব মোকাবেলায় পরিকল্পনায় থাকা দরকার এই শিল্পের শ্রমিকদের স্বার্থ। এগুলো নিয়ে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা ও ভাবনাচিন্তা করা জরুরি।

সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে যে দেরি হয়েছে সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। তদুপরি এগুলো এখন যেভাবে নেওয়া হচ্ছে এবং যেভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে তাতে সমন্বয় ও স্বচ্ছতার অভাব সুস্পষ্ট। এই ধরণের অস্বচ্ছতার কারণেই জনসাধারণের মনে বিভিন্ন ধরণের সংশয়, সন্দেহ এবং আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারের ভাষ্যের বাইরেও অনেক ধরণের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে।

মনে রাখাতে হবে, স্বচ্ছতার অভাব বিপদ ডেকে আনে; সেই বিপদের শিকার হন সাধারণ মানুষ। এই মহামারির সূচনা থেকে বিভিন্ন দেশে তা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে সরকারের কাছে এখনই স্বচ্ছতার দাবি তোলা নাগরিকদের দায়িত্ব।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো

ariaz@ilstu.edu

Comments

The Daily Star  | English

Onion price rises on supply crunch

Onion prices at retail markets in Dhaka rose by Tk 10 to Tk 15 per kilogramme (kg) over the past week, deepening the woes of low and fixed-income people..Wholesale and retail traders across the capital said a supply crunch is causing the volatility in onion prices..Nurul Alam Shikdar

30m ago