শূন্য হাতে ঢাকায় এসেছিলেন নায়কদের নায়ক রাজ্জাক

razzak
নায়করাজ রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত

নায়করাজ রাজ্জাকের ৭৮তম জন্মদিন আজ (২৩ জানুয়ারি)। জীবদ্দশায় তিনি পেয়েছিলেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি আজীবন সম্মাননাও উঠেছিলো তার ঘরে। তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিলেন দর্শকরা। নন্দিত নায়ক ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন নায়কদের নায়ক। এদেশের সোনালি দিনের নায়ক থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ অবধি তিনি ছিলেন সিনেমার জন্য নিবেদিত প্রাণ।

কলকাতা থেকে শূন্য হাতে ঢাকা শহরে এসেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। স্ত্রী লক্ষ্মী, শিশু পুত্র বাপ্পারাজ এবং রাজ্জাক ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকার কমলাপুরে এসে নামেন। সে সময়ে উপমহাদেশে দাঙ্গা চলছিলো।

ঢাকায় এসে কমলাপুরে ত্রিশ টাকার ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন তিনি।

সেই গল্প ষাটের দশকের। ঢাকায় এসে রাজ্জাক সংগ্রামী জীবন শুরু করেন। এক নতুন অধ্যায় দেখা দেয় তার জীবনে। চেনা শহর কলকাতা ছেড়ে অচেনা শহর ঢাকায় তিনি। কে তাকে কাজ দিবে? কীভাবে সংসার চলবে? কতোরকম চিন্তা! কষ্ট, সংগ্রাম এবং স্বপ্নকে সাথী করে রাজ্জাক পথচলা শুরু করেন।

তারপর ধীরে ধীরে রাজ্জাক হয়ে উঠেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। সাফল্য তার হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছিলো। সেজন্য অবশ্য কম কষ্ট করতে হয়নি তাকে। মাঝপথ থেকে কখনো সরে যাননি।

বাংলাদেশের সিনেমায় অনেক নায়ক এসেছেন। অনেক নায়ক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কিন্তু, নায়করাজ রাজ্জাকের মতো জনপ্রিয় নায়ক আর কেউ ছিলেন না। ষাটের দশক থেকে শুরু করে টানা কয়েক দশক তিনি নায়ক হিসেবে ছিলেন। এদেশের ঘরে ঘরে রাজ্জাক নামটি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারিত হতো এক সময়ে।

জন্মদিনে তিনি নেই। তবে রয়ে গেছে তার সোনালি যুগের সিনেমাগুলো।

রাজ্জাকের জন্ম কলকাতায়। শৈশব ও ছেলেবেলা কেটেছে সেখানেই। স্কুলজীবন থেকে অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। স্কুলের বার্ষিক নাটকে তার উপস্থিতি থাকতোই। এভাবেই কলকাতায় রাজ্জাকের অভিনয় শুরু।

তিনি একসময় চিন্তা করেছিলেন সিনেমায় অভিনয় করবেন। পর পর তিনটি সিনেমায় অভিনয় করেন খুবই ছোট ছোট চরিত্রে। সিনেমাগুলি হলো ‘শিলালিপি’, ‘পঙ্কতিলক’, ‘রতন পাল বংগালী’।

তরুণ বয়সে রাজ্জাক বম্বে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে ছিলেন দুই মাস। যে স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলেন তা পূরণ করতে পারেননি। ফের কলকাতায় ফিরে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটতে থাকে তার। কিন্তু অভিনয় ভুলতে পারেননি। পরিচালকদের পেছনে ঘুরতে থাকেন। সুযোগ আসে না।

কিছুদিন চাকরিও করেছিলেন কলকাতায়। মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিয়েও করেন। স্ত্রী লক্ষ্মীকে নিয়ে কাটতে থাকে দিন, কিন্তু অভিনয়ের নেশা যেনো কাটে না।

১৯৬৪ সালে ছেলের বাবা হয়েছেন। ছেলে বাপ্পারাজ ও স্ত্রী লক্ষ্মীকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে পাড়ি জমান ঢাকা শহরে। সে সময়ে ঢাকায় তার কেউ ছিলো না। সম্বল ছিলো একটি চিঠি। কলকাতা থেকে ঢাকার চিত্র পরিচালক আবদুল জব্বার খানের কাছে ওখানকার নাট্যপরিচালক পীযুষ বসু লিখে দিয়েছিলেন চিঠিটি। চিঠির বিষয় ছিলো- রাজ্জাক যেনো অভিনয় করতে পারে।

চিঠিটিই ছিলো সে সময়ে রাজ্জাক এর সম্বল। আর চোখে মুখে ছিলো স্বপ্ন। ছিলো হতাশাও। অস্থিরতাও ছিলো। তারপরও রাজ্জাক পিছপা হননি।

প্রথমবার চেনা শহর কলকাতা ছেড়ে অচেনা শহর ঢাকায় এসে নামেন রাজ্জাক। চিঠি নিয়ে দেখা করার পর পরিচালক আবদুল জব্বার খান সেই সময়ের কয়েকজন নামকরা পরিচালকের কাছে রাজ্জাককে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

তারপর আবদুল জব্বার খান রাজ্জাককে পাঠিয়েছিলেন ইকবাল ফিল্মসে। সেখান থেকে নির্মিত হয়েছিলো ‘উজালা’। কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘উজালা’য় সহকারী পরিচালক হিসেবে ঢাকায় নতুন জীবন শুরু করেছিলেন রাজ্জাক।

এদিকে, ঢাকায় সে সময়ে ত্রিশ টাকা মাসিক ভাড়ায় রাজ্জাক স্ত্রী ও পুত্র বাপ্পারাজকে নিয়ে বাসা ভাড়া নেন কমলাপুরে। ঢাকাই সিনেমায় নায়ক হওয়ার জন্য রাজ্জাকের কঠোর সংগ্রাম মূলত শুরু হয়েছিলো আরও বেশি করে।

সহকারী পরিচালক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য কাজ করতে থাকলেও রাজ্জাকের মন পড়ে থাকতো অভিনয়ের প্রতি। তারপর ছোট-ছোট চরিত্রে অভিনয় দিয়ে এদেশের সিনেমায় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রাজ্জাক। সেসব সিনেমাগুলো হচ্ছে- ‘ডাক বাবু’, ‘কার বউ’, ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’।

এক সময়ে সুযোগ এসে যায় তার। বিখ্যাত নির্মাতা জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ সিনেমায় নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে। রাজ্জাক নায়িকা হিসেবে পান সুচন্দাকে।

‘বেহুলা’ দর্শকরা গ্রহণ করেন। রাজ্জাক নামটি নায়ক হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাজ্জাক ও সুচন্দাকে জুটি করে জহির রায়হান নির্মাণ করেছিলেন ‘আনোয়ারা’। বিখ্যাত লেখক মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন রচিত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস থেকে নির্মিত সিনেমাটিতে আনোয়ারার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করার পর দর্শকরা পেয়ে যায় নতুন এক রাজ্জাককে।

একই পরিচালকের ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’ সিনেমায়ও তিনি নায়ক হয়ে আসেন।

সফলতার গল্প ঘরে আসতে শুরু করে রাজ্জাকের। পরিচালকরা তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। পরিচালকদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে থাকা রাজ্জাকের ভাগ্য বদলে যেতে থাকে। সিনেমার পেছনে তিনি দৌড়েছিলেন। এখন সিনেমা তার পেছনে দৌড়াতে থাকে।

রাজ্জাক হয়ে উঠেন ঢাকার সিনেমার সেই সময়ের এক নম্বর নায়ক। তার নামের আগে যোগ হয় রাজ উপাধি। সামাজিক, রোমান্টিক, লোককাহিনী, অ্যাকশন- সব ঘরনার সিনেমায় রাজ্জাক নায়ক হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন সময়ের পলচলায়।

শুধু কী তাই? সে সময়ের সব শীর্ষ নায়িকার বিপরীতে নায়করাজ রাজ্জাক সফল নায়ক ছিলেন। তবে রাজ্জাক-কবরী জুটি বেশি আলোচিত হয়েছিলো।

শূন্য হাতে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসা সেই রাজ্জাক সময়ের ব্যবধানে একসময় গুলশানে বাড়ি করেন। প্রতিষ্ঠা করেন রাজলক্ষ্মী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠা করেন রাজলক্ষ্মী কমপ্লেকস। অভিনয়, প্রযোজনা, ব্যবসা, পরিচালনা, সংসার– সবকিছু সামলিয়ে রাজ্জাক টানা কয়েকটি দশক ঢাকাই চলচ্চিত্রের রাজা হয়েছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh's 8 mega projects cost $7.5b more for graft, delay

Taskforce report: 8 mega projects cost $7.5b more for graft, delay

The initially estimated costs of these projects were $11.2 billion in total

12h ago