ক্যান্সার হাসপাতাল নিজেই ক্যান্সার আক্রান্ত
১২ বছরের বেশি সময় আগে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য আটটি অত্যাধুনিক আর্টিফিশিয়াল রেসপিরেটরি ভেন্টিলেটর (এআরভি) মেশিন কেনা হয়েছিলো।
আইসিইউর জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই যন্ত্রগুলোর প্রত্যেকটি ৭০ লাখ টাকায় কেনা হলেও আশ্চর্যজনকভাবে একবারের জন্যও সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি। আইসিইউর ভেতরে এক কোণায় অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে যন্ত্রগুলো। এখন হাসপাতালটির আইসিইউতে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেই।
অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাসপাতালটিতে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা তিন বছর আগে চালু হলেও ভেন্টিলেটরগুলো এখনও বসানো হয়নি। আরও খারাপ খবর হলো, এর মধ্যেই ভেন্টিলেটরগুলোর মাদারবোর্ড চুরি হয়ে গেছে। ফলে এ যন্ত্রগুলো এখন পুরোপুরি অকেজো।
রাজধানীর একমাত্র সরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে এরকম আরও নানা অনিয়মের সন্ধান পেয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।
দেশের নিম্নআয়ের ক্যান্সার রোগীদের একমাত্র ভরসা জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ক্যান্সার নিয়ে গবেষণাকারী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এছাড়াও, প্রতিবছর আরও প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
অবহেলার গল্প
আইসিইউতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বসানোর জন্য বছরজুড়ে বেশ কয়েকবার পরিচালককে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে পাঠানো সর্বশেষ চিঠিতে বলা হয়েছিলো, “আটটি ভেন্টিলেটর মেশিন বহুদিন ধরেই পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন বিভাগ থেকে মুমূর্ষু রোগীদের আইসিইউতে পাঠাতে হয়। অনেকেরই জটিল অপারেশনের পরে ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু, তাদেরকে এ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
আইসিইউ থেকে বিভিন্ন সময় মৌখিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সমস্যাগুলোর কথা জানানো হয়েছে- এমন কথারও উল্লেখ রয়েছে চিঠিটিতে।
সেই চিঠিগুলোর প্রতিলিপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।
হাসপাতালের একমাত্র আইসিইউ বিভাগটির শুরুতে আটটি সিট থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র চারটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ বিভাগের একজন ডাক্তার এ সমস্যার কথা জানিয়ে বলেন, “এটাকে ঠিক আইসিইউ বলা চলে না। কারণ, একটি আইসিইউতে অতিপ্রয়োজনীয় যে যন্ত্রগুলো থাকার কথা এখানে তা নেই। আমরা রোগীদেরকে আইসিইউতে চিকিৎসার নামে ধোঁকা দিচ্ছি। কারণ, এখান থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব না।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও একজন ডাক্তার জানান, “সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো পরিচালক এই বেহাল অবস্থা সম্পর্কে সবকিছুই জানেন। কিন্তু, তিনি আইসিইউকে কার্যকর করার জন্য কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এটা অবহেলা ছাড়া আর কিছুই না। ভেন্টিলেটরের মাদারবোর্ডগুলো চুরি হওয়ার পরেও আমরা তাকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।”
দায়িত্বে আসার অনেক আগেই এই যন্ত্রগুলো কেনা হয়েছিলো জানিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মোআররফ হোসেন বলেন, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগে থেকেই এ যন্ত্রগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ১০ বছর পর মেডিকেল যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে যায়।”
গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে তার অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটি (এলপিআর) শুরু হয়েছে।
ভেন্টিলেটর ছাড়া আইসিইউ বিভাগটি কী অবস্থায় আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ক্যান্সার হাসপাতাল অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে আলাদা। ভেন্টিলেশন এখানে রোগীদের অবস্থার উন্নতি ঘটায় না। বরং খরচ বাড়ায়। তাই এখানে ভেল্টিলেটরের খুব বেশি প্রয়োজন নেই।”
অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে আরও যন্ত্রপাতি
কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্রের মতো আরও বেশকিছু যন্ত্র অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে এই হাসপাতালে। দুটি আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনলাইজার মেশিন কেনা হয় ২০০৫ সালে। এর একটি লাগানো হয়েছিলো অপারেশন থিয়েটারে। পরে সেটি নিয়ে যাওয়া হয় আইসিইউতে। কিন্তু, হাসপাতালের নথিপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় রিএজেন্টের অভাবে গত তিন বছর ধরে অচল হয়ে রয়েছে এই দামি যন্ত্রগুলো। রিএজেন্টের চাহিদার কথা আইসিইউ থেকে ২০১৭ সালে চিঠি দিয়ে হাসপাতালের পরিচালককে জানানো হয়েছিলো। কিন্তু, এখন পর্যন্ত রিএজেন্ট পায়নি তারা। আর অন্য যন্ত্রটি লাগানোই হয়নি। দুটি যন্ত্রই এখন আইসিইউর ভেতর একটি রুমে পড়ে আছে। হাসপাতাল সূত্রগুলো জানায়, ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ঘরে এই যন্ত্র রাখার কথা থাকলেও যন্ত্র দুটি যেখানে পড়ে রয়েছে সেখানে এসি নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক মোআররফ বলেন, “মেশিন দুটির অবস্থা সম্পর্কে আমি কিছুদিন আগে জেনেছি। এগুলো কাজে লাগানোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
ব্লাড ব্যাংকে একটি এফারেসিস মেশিন (রক্ত কণিকা পৃথক করার যন্ত্র) গত তিন বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। রক্ত থেকে অণুচক্রিকা (রক্তক্ষরণ বন্ধকারী রক্ত কণিকা) আলাদা করা হয় এই যন্ত্র দিয়ে। সম্প্রতি এই হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সাদা একটি পর্দা দিয়ে যন্ত্রটি ঢেকে রাখা হয়েছে।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, যে মেশিনগুলোর মাদারবোর্ড চুরি হয়ে গেছে, ত্রুটিপূর্ণ মাদারবোর্ড লাগিয়ে সেগুলো মেরামত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল সূত্রগুলো।
ফুসফুসের ক্যান্সার সনাক্ত করতে কাজে লাগে এমন অন্তত চারটি ব্রঙ্কস্কোপ যন্ত্র হাসপাতালের স্টোর রুমে পড়ে আছে। গত তিন বছর ধরে এই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ব্রঙ্কস্কোপ যন্ত্রগুলোর ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক বলেন, “যন্ত্রপাতি থাকলেও এগুলো চালানোর মতো লোকবল বা টেকনিশিয়ানের পদ নেই। এটা সমাধানের চেষ্টা করছি আমরা।”
দামি যন্ত্রপাতি ফেলে রেখে জনগণের টাকার অপচয় হচ্ছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি কোনো ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত নই। হাসপাতালের ১১০০ কর্মীর দায় নেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব না। কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেবো।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “ভয়ানক দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সরকারি টাকা অপচয়ের উদাহরণ এটি। রোগীদের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন যেখানে জড়িত সেখানে পুরোপুরিভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে জনকল্যাণের দিকটি। জবাবদিহিতা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণেরও কোনো বালাই নেই সেখানে।”
তিনি আরও বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সিনিয়র কর্মকর্তারা শুধু তাদের মূল দায়িত্ব পালনেই ব্যর্থ হননি, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবের মধ্যে থাকা দেশের স্বাস্থ্যখাতে লজ্জাজনক একটি উদাহরণও তারা তৈরি করেছেন।”
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক এই সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান আরও বলেন, “অবিশ্বাস্যরকম এই দায়িত্বহীনতার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিচার হওয়া উচিত। আমার সন্দেহ হচ্ছে যে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য সরকারের অবশ্যই তদন্ত করে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
Comments