বৈপরীত্যের একটি বছর

মার্চ ১২ ২০১৯, ডাকসুর পুনর্নিবাচনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মিছিল। ছবি: এমরান হোসেন

শেষ হয়েছে ২০১৯। পেছনে তাকিয়ে দেখা যাক বিগত বছরের দিকে, কী হয়েছে বছরজুড়ে? এক্ষেত্রে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘টুয়েলফথ নাইট’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যের একটি উক্তি হতে পারে ২০১৯ সালের যথার্থ বর্ণনা। ‘যদি এটি একটি মঞ্চে মঞ্চায়িত করা হতো, তাহলে আমি এটিকে একটি কল্পকাহিনী হিসেবে নিন্দা করতে পারতাম।’ কিন্তু, আমাদের চারপাশে বিগত এক বছরে যা ঘটেছে তা কোনো কল্পকাহিনী নয়! ঘটনাবলীর ভেতরে রয়েছে বৈপরীত্য– একদিকে প্রত্যাশা, অন্যদিকে বাস্তবতা। যা দৃশ্যমান হয়েছে আর যা তার মর্মবস্ত– এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক সহজেই দৃষ্ট।

বছরজুড়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বৈপরীত্যের বিষয় ছিলো- ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে এই দাবি যে, দেশে গণতন্ত্র বহাল আছে, যখন পুরো বছরজুড়ে সম্মেলন কিংবা কোনো র‌্যালির অনুমতি পায়নি বিরোধীদলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি। অহেতুক মামলা দেওয়া হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ ঘটনা। কোনো ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেওয়া হলেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তা রুখে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, ভিন্নমত পোষণের অধিকারও হারিয়েছে সাধারণ মানুষ।

গণতন্ত্রের অবস্থা কী তা বোঝার জন্যে কেবলমাত্র ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে গঠিত কার্যত একদলীয় সংসদের দিকে তাকানোই যথেষ্ট নয়, বরঞ্চ এটাই লক্ষণীয় যে, রাজনীতিই অনুপস্থিত হয়ে গেছে, রাজনীতির চর্চা এখন আর দৃশ্যমান নয়। রাজনীতির মৌলিক দুটি দিক হলো- সাধারণ মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এ দুটি মৌলিক দিকই প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে ২০১৯ সাল জুড়ে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত আগে প্রণয়ন করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। যেটি কার্যত সফল। কেননা, গোটা সাইবার স্পেস এখন হয়ে উঠেছে সরকারি ভাষ্যের প্রতিধ্বনি বা ইকো-চেম্বার, কিংবা দন্তনখরহীন আলোচনার মাধ্যম। ভিন্নমত পোষণকে রীতিমতো অপরাধে পরিণত করা হয়েছে। এই যে গণতন্ত্র এক ফাঁপা খোলসে পরিণত হয়েছে তা কিন্তু দুর্ঘটনাবশত হয়নি, হয়েছে পরিকল্পনা করেই। এটাই হচ্ছে নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র বা ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ানিজমের চরিত্রের লক্ষণ; হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা শাসন ব্যবস্থার একটি বিশেষ ধরণ। গণতন্ত্রের যে মুখোশটুকু টিকে আছে তা হচ্ছে নির্বাচন; কিন্তু তারও এমন ক্ষতি সাধিত হয়েছে যা সম্ভবত মেরামতের অযোগ্য। বৈধতার চাদর দেওয়ার জন্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। সেই কারণেই ২০১৯ সালের বড় ধরণের বৈপরীত্য এখানে যে ক্ষমতাসীনরা দাবি করছেন দেশে গণতন্ত্র বহাল আছে, কিন্তু আসলে রাজনীতিই হারিয়ে গেছে।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, যেটিতে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং দল একজোট হয়ে ক্ষমতাসীনদের বিজয়ী করেছে সেটি গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতিই সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন, পাঁচ পর্বে উপজেলা নির্বাচন। কিন্তু, সেসব নির্বাচনে জনগণের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। তারা তাদের মতামত জানিয়েছেন– তাদের নীরবতার মাধ্যমে। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়াই ছিলো তাদের ভোট দেওয়া। আসলে অনাগ্রহ আর নীরবতার মাধ্যমেই আসলে তারা তাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু, সে বার্তা পৌঁছায়নি সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশনের কাছে। কারণ, তারা শুধু কোনোমতে নির্বাচন করে তাদের তথাকথিত ‘দায়িত্ব’ পালন করেই খুশি।

নির্বাচনী প্রক্রিয়া ধ্বংস করার এই যে নীলনকশা, দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি শুধু জাতীয় নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটেছে। ডাকসু নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন।

এছাড়া, কেউ যদি বিভিন্ন পেশাদার সংগঠন কিংবা ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচনগুলোর খোঁজখবর করেন তা হলে দেখবেন যে খুব কমই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণত ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ একদল প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, যেমনটি করা হয়ে থাকে একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতাও ধীরে ধীরে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

একটি শক্তিশালী বিরোধীদল এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপের অভাবে পুরো দেশ এবং দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এখন ক্ষমতাসীন দলের হাতে। তবুও প্রত্যেক ঘটনাতেই ক্ষমতাসীন দল যেনো ভীত হয়ে পড়েন।

যখনই কোনো আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়, তখনই সরকার দল ও তাদের সমর্থকরা বলেন, এগুলো দেশকে অস্থিতিশীল করার ‘ষড়যন্ত্র’। অথচ এগুলো হচ্ছে সমাজে বিরাজমান ক্ষোভের প্রকাশ। যখনই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের চেষ্টা করেছে, একই কথা বলেছে সরকারি দল ও তাদের সমর্থকেরা। কিন্তু, এসব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান বা তা সমাধানের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং এগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখেছে সরকার। ফলস্বরূপ বল প্রয়োগ করে ভীতি তৈরি করেছে সরকার। আর এগুলোই এখন শাসনের প্রাথমিক উপায়ে পরিণত হয়েছে।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যা– ৪৫৬, আর গুম ৮৩। এই পরিসংখ্যানই বোঝায় প্রশাসনের মানসিকতা।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অনীহা ক্ষমতাসীন দলের মানসিকতাকেই তুলে ধরে পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতো প্রায়শই, আইনি প্রতিবাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা, সমালোচকদের চুপ করে রাখার ভার তুলে দেওয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে।

আপাত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সত্ত্বেও, নাগরিকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার বোধ সহজেই দৃষ্ট। এগুলো সরকারি ভাষ্যের ওপর মানুষের আস্থার অভাব থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। এ কারণেই সৃষ্টি হয় ‘গুজব’ তৈরির সুযোগ। এই যে গুজবের কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়, তার কারণ এই নয় যে, কেউ ষড়যন্ত্র করছে। এটির প্রধান কারণ ক্ষমতাসীন দল যা বলছে সেটির ওপর মানুষের আস্থা নেই।

বিরোধীদল বিএনপি নিঃসন্দেহে বর্তমানে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে এখনো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। এর জন্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও তাদের নিয়ে ঠাট্টা করে থাকেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও কিছু হলেই বিএনপিকেই দোষারোপ করা হয়। এমনকী, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত তালিকায় থাকা ভুলের ব্যাপারেও বিএনপিকে দোষারোপ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ভোটের পর বিএনপি আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। কিন্তু, বিগত এক বছরে রাজপথে তাদের দেখা যায়নি। এতে মনে হয়েছে, আন্দোলন করা নয়, শুধু আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি দিয়েই সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ঠেকানো যাবে এমনই মনে করে বিএনপি। বিএনপি নিজেদের পুনর্গঠিত করতে, নিজেদের মধ্যকার বিভেদ দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিজেদের নেতৃত্ব, অর্থাৎ দলের দায়িত্বে কে আছেন- নির্বাসিত তারেক রহমান, না কী ঢাকায় নেতারা- এ ব্যাপারেও স্বচ্ছতা আনতেও তারা ব্যর্থ। তবে কেবল যে বিএনপির কর্মকাণ্ড এবং তাদের প্রতিশ্রুতির মধ্যেই পার্থক্য ছিলো তা নয়।

আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের আগে দলে নতুন নেতৃত্ব আনা হবে, দল ‘শুদ্ধ’ করা হবে, এমন কথাই বলা হচ্ছিলো। তবে শেষমেশ প্রায় একই নেতৃত্ব রাখা হয়েছে। এমনকী, নতুন কমিটি নির্বাচনে দলের তৃণমূল নেতাদের কোনো ভূমিকা ছিলো, তাও তারা বোঝানোর কোনো ধরনের চেষ্টা করেনি। এটি আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু না। কারণ, যুবলীগ ও কৃষক লীগের নেতৃত্বও একইভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সরকার যখন ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে, তখন যারা আশাবাদী হতে চান তারা হয়তো একটু আশার আলো দেখেছিলেন। সেই অভিযান চলাকালে দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করাকে অনেকেই বর্ণনা করেন ‘ঐতিহাসিক ও নজিরহীন’ একটি ঘটনা বলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা বলেছিলেন, কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না। কিন্তু, শেষে দেখা গেলো, বড় রুই-কাতলরা রয়ে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। দলের মাঝারি পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেই অভিযান শেষ করা হয়েছে।

২০১৯ সালের আরেকটি বৈপরীত্য হলো- সরকারের বক্তব্য এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান অনুভূতি। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সম্পর্কের স্বর্ণযুগের’ বলেই জোর দেয়। কিন্তু, অক্টোবর এবং নভেম্বরে শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে তাকে দেওয়া সংবর্ধনা ছিলো এর সঙ্গে সঙ্গতিহীন; এছাড়াও, নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কিংবা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কী না, সেটি নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই ভারত সরকারের।

বাংলাদেশিদের মধ্যে একটি ধারণার জন্ম নিচ্ছে যে, দুদেশের পারস্পরিক বিনিময় অসমই থেকে যাচ্ছে। এ ধরনের উপলব্ধিই সৃষ্টি করছে ভারতবিরোধী মনোভাব।

তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভারতীয় নীতির যেকোনো সমালোচনাকে সহিংসভাবে দমন করার দায়িত্ব নিজেদের ওপর টেনে নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেসবুকে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি সম্পর্কে সমালোচনামূলক মন্তব্য করার কারণে অক্টোবরে বুয়েটশিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যা এবং এনআরসি ও সিএএ ইস্যুতে সমাবেশ করার চেষ্টা করায় ডিসেম্বরে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা।

এই সবের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হচ্ছে- এর থেকে বের হওয়ার উপায় কী? পরবর্তী বছরে কীভাবে এই সব বৈপরীত্য এড়ানো যায়? অতীত অপরিবর্তনীয় এবং রাজনীতি অনিশ্চিত হতে পারে; কিন্তু, ভবিষ্যৎ তো পূর্ব নির্ধারিত নয়। ভবিষ্যৎ তৈরি করা যায় না, এটি ভাবা ভুল। ইতিহাস তো মানুষই তৈরি করে। শেষে শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের একটি উক্তি মনে পড়ছে। ‘প্রিয় ব্রুটাস, দোষ ভাগ্যের নয়, দোষ আমাদেরই। কারণ আমরা আজ্ঞাধীন।’!

আলী রীয়াজ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির (আইএসইউ) রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

Comments

The Daily Star  | English

Regulating online hate speech 'not censorship': UN rights chief

Instead, Meta platforms including Facebook and Instagram, 'would use community notes similar to X (formerly Twitter), starting in the US'

30m ago