ডিজিটাল দুনিয়ায় বড় হওয়া
সাত বছর বয়সী ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে ৮ ইঞ্চির একটা ট্যাবলেট সহজে ধরতে পারার কথা না। কিন্তু, কর্মজীবী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান রিয়ানা কোনো মতে এই যন্ত্রটি নিয়ে খেলাধুলা করা শিখে নিয়েছে। বাড়িতে তার একমাত্র খেলার সাথী এই ৮ ইঞ্চির ট্যাবলেটই।
রিয়ানা যখন একটু বড় হলো, স্কুলে যেতে শুরু করলো তখন সে আবিষ্কার করলো যে স্কুলে বন্ধু বানানো বেশ কঠিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রিয়ানা আরও বিচ্ছিন্ন ও একা হতে থাকলো। ১৪ বছর বয়সী রিয়ানার বন্ধুরা সবাই ৮ ইঞ্চির একটি ট্যাবলেটের স্ক্রিনেই থাকে। বাবা-মা অবাক হয়ে রিয়ানার অস্বাভাবিক আচরণ খেয়াল করতে থাকেন, দেখেন, প্রতি রাতেই রিয়ানা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতে যাচ্ছে।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সে মাদকাসক্ত ও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েছে। বাবা-মায়ের সারাটা সময় এখন শুধুই অনুশোচনায় কাটছে। তারা জানে, বাড়ন্ত বয়সে পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবেই রিয়ানা এখন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত।
আমরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, এ প্রজন্মের ‘ডিজিটাল শিশু’দের করুণ পরিণতি। আমরা প্রায় সবাই প্রযুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানি। কিন্তু, একজন উঠতি বয়সী শিশুর উপরে এর প্রভাব কতোটুকু তা কি আমরা জানি?
ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল অব আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের প্রধান রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা ব্যাখ্যা করেছেন, “অনেক গবেষণা জানাচ্ছে অতিরিক্ত সময় ফোনের ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের শারীর বৃত্তীয়, সামাজিক, মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অবশ্যই বাবা-মা সবসময় তাদের বাচ্চাদের জন্য সেরা জিনিসটিই চান এবং সচেতনভাবে তাদের বাচ্চাদের কখনই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেন না। তবে যেহেতু প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রভাব বাড়ছে, তাই আমাদের বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর ওভার-এক্সপোজারের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে নিজেদের শিক্ষিত করা এবং সেই অনুসারে আমাদের বাচ্চাদের লালনপালন করা উচিত। বর্তমানে সাইবার স্পেসে অনেক কিছু ঘটছে যার সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত না।”
প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার ঢাকা শহরের শিশুদের মানসিক বিকাশে কেমন প্রভাব রাখছে সে আলোচনায় অ্যাপোলো হাসপাতালের চাইল্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান ডা. ফারজানা ইসলাম জানান, “অনেক মা-বাবাই আজকাল ডিভাইসের ওভার-এক্সপোজারের ফলে যোগাযোগের দুর্বলতা এবং কথা বলতে সমস্যায় পড়ছে, এমন পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের আমাদের কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরাও আজকাল ফোন ও ল্যাপটপে অতিরিক্ত সময় কাটানোর কারণে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। বাচ্চারা রঙিন ডিজিটাল দুনিয়ায় অধিকাংশ সময় কাটানোর ফলে বাস্তবজগৎ তাদের কাছে অত্যন্ত সাদামাটা হয়ে পড়ছে। ফলে, তাদের সামাজিকীকরণেও অসুবিধা হচ্ছে।”
মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগ্রহী এবং বেশ সক্রিয়। বিশ্বব্যাপী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কতোখানি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা হচ্ছে।
গবেষণায় জানা যাচ্ছে, এই সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার কারণে হতাশা ও বিষণ্ণতার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই আত্মহত্যা করেছে ১৪৮ জন শিশু এবং এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব অনেক বেশি। আজকাল শিশুরা যে ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে সেগুলোও বেশ উদ্বেগজনক। ফলে সাইবার সুরক্ষা আইন এবং অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বও আমাদের সামনে আসছে।
ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে কমপক্ষে ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, সাইবার বুলিং এবং ডিজিটাল হয়রানির শিকার হয়। প্রাপ্তবয়স্করা যখন এ জাতীয় পরিস্থিতিতে পড়েন, তখন তাদের কাছে ডিজিটাল সুরক্ষা আইন এবং তাদের নিজস্ব অধিকারগুলো সম্পর্কে জানার সুযোগ আসে। কিন্তু, শিশুদের ক্ষেত্রে এমনটি খাটে না। ফলে বাচ্চাদের সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি এবং এর ফলে জন্ম নেওয়া ট্রমাও বাচ্চাদের বহু বছর পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়ায়।”
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুরা ইন্টারনেটে কী দেখছে, কী করছে অভিভাবক তা নজরদারিতে রাখেন। এজন্য অনেক মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং সফটওয়্যারও রয়েছে। কিন্তু, এই সফটওয়্যারগুলো কি আদৌ কোনো সাহায্য করে?
অনেকেই যুক্তি দেখান যে, নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুর প্রতি শিশুদের আগ্রহ প্রবলভাবে থাকে। তাই নিষেধাজ্ঞা আরোপ অনেকক্ষেত্রে ভালোর চেয়ে ক্ষতির কারণই বেশি হতে পারে। ক্রমাগত নজরদারি বাচ্চাদের গোপনীয়তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং এর ফলে শিশু জেদি হয়ে মা-বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে বিকল্প উপায়ে ইন্টারনেটে সময় কাটানো শিখে নেয়।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এর মতে, তিন থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের প্রতিদিন এক ঘণ্টার বেশি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা উচিত না। কর্মজীবী মা-বাবা, বিশেষ করে যারা কাজ করার সময় বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার প্রয়োজনে বিভিন্ন ডিভাইস বাচ্চাদের হাতে দিয়ে থাকেন, তাদের পক্ষে এ নিয়ম মেনে চলা প্রায় অসম্ভব। যা প্রয়োজন তা হলো নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞার ভারসাম্য।
বাচ্চারা যাতে এমনটি না মনে করে যে তাদেরকে অত্যধিক বিধিনিষেধের আওতায় আনা হচ্ছে। পাশাপাশি বাচ্চাদের বিনোদনমূলক ভিডিওর পাশাপাশি শিক্ষামূলক বিভিন্ন কন্টেন্ট দেখার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।
ডা. ফারজানা ইসলাম জানান, “আজকাল মা-বাবারা শিশুদের ব্যাপারে অত্যধিক প্রতিরক্ষামূলক এবং উদ্বিগ্ন। বাচ্চারা কান্নাকাটি করলে তারা অনেকসময় ডিভাইস হাতে দিয়ে শান্ত করেন বটে, তবে শিশুরা প্রযুক্তির সংস্পর্শে নেতিবাচক পরিণতির মুখোমুখি হবে এমনটিও তারা চান না। অভিভাবকদের প্রথম ভুল বাচ্চার অনুরোধ বা কান্নাকাটির জন্য তার হাতে ডিভাইস তুলে দেওয়া। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সমাজে মা-বাবার প্রশিক্ষণ ও সামাজিক শিক্ষার একটি বড় ব্যবধান রয়েছে।”
ইউনিসেফ বাংলাদেশ, গ্রামীণফোন এবং টেলিনর গ্রুপ অনলাইনে নিরাপদে থাকার জন্য দেশের ১ কোটি ২০ লাখের বেশি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি, এ প্রকল্পটি শিশুদের অনলাইন সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য চার লাখ পিতামাতা, শিক্ষক ও পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবে। ‘বাংলাদেশে শিশু অনলাইন সুরক্ষা জোরদার এবং স্কেলিং’ নামের এই প্রকল্পটি দুই কোটি লোকের কাছে পৌঁছে যাবে এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার লোককে সহায়ক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে।
যদিও শিশুদের উপর প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরূপ প্রভাব বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে এনিয়ে গবেষণায় এখনো ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কেননা, শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার একটি সাম্প্রতিক ঘটনা এবং এই শিশুদের বেশিরভাগ এখনও বয়ঃসন্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে বা অতিক্রম করতে পারেনি। আর তাই, শিশু বয়সে ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো এখনো অধ্যয়ন করা সম্ভব হয়নি।
তবে শিশুদের প্রাথমিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে তা সর্বজনস্বীকৃত। তাই বাচ্চাদের ছোট হাতে ইন্টারনেট প্রযুক্তির মতো ব্যাপক জিনিস তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে।
Comments