‘সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে...’

salil_chowdhury-1.jpg
সলিল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

আসামের চা বাগানে বেড়ে ওঠা। কাছ থেকে দেখেছেন শ্রমিক মেহনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। তাই গণসংগীতে জন্মেছিলো এক অন্যরকম ভালোলাগা। তো চল্লিশের দশকে একদিন নতুন কয়েকটি গণসংগীত নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গেলেন। গানগুলো শোনালেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন যেহেতু রাজনৈতিক গান, এগুলো তো আর রেকর্ড করা যাবে না বরং অন্য গান শোনাও। কিছুটা মন খারাপ করে ফিরে আসছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়লো একটা কবিতার কথা। আবার ফিরে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। গিয়ে কবিতার খাতা খুলে অর্ধেক লেখা কবিতাটা সুর করে শোনালেন।

শুনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম এ এক আশ্চর্য কীর্তি। বলা যায় সেই মুহূর্তেই জন্ম নিলো রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলার সেরা কাব্যগীতি: ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’।”

উনি সাধারণত কখনও একটা গান পুরোপুরি শেষ করতেন না। অর্ধেক করে রেখে দিয়ে অন্য গানে চলে যেতেন বা কবিতা লিখতে বসে যেতেন। যখন রেকর্ডিংয়ের জন্য শিল্পী গানটা শিখতে আসতেন, তখন বাকি গানটা লিখে দিতেন। বাসায় ফিরে শেষ করলেন ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’ গানের বাকি অংশ। গানের রেকর্ড বেরোলো পুজোতে। বাকিটা ইতিহাস।

বলছি বাংলার অন্যতম সেরা মেধাবী গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও কবি সলিল চৌধুরীর কথা। শুধু বাংলা কেনো বলছি, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত মজেছে তার গানে ও সুরে। তিনি দক্ষিণ ভারতেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন।

একবার সলিল চৌধুরী সপরিবারে দক্ষিণে গেলেন বেড়াতে। হঠাৎ এক নারী এসে সলিল চৌধুরীর স্ত্রী সবিতা চৌধুরীর হাত ধরে বললেন, “খুব সাবধানে আর যত্নে রাখবেন সলিল বাবুকে। কারণ উনার হাতে আমাদের গোটা সভ্যতার সুর রয়েছে। উনার সুরে আমরা বাঁচি, আমরা হাসি, আমরা কাঁদি।”

আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা ও গণসংগীত প্রণেতা সলিল চৌধুরী ১৯২৩ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ভারতের আসামে। গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক জুড়ে সলিল চৌধুরী ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। বিটোভেনের সিম্ফনি, মোৎসার্টের জি-মাইনর ফর্টিএথ সিম্ফনি, ই-মাইনর, জি-মাইনর কর্ডের প্রতি তার অনুরাগ থেকেই বাংলা ও হিন্দি ভাষায় উপহার দিয়েছেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী সব কালজয়ী গান।

পশ্চিমা দেশের সংগীতের প্রতি যেমন অনুরক্ত ছিলেন, ঠিক তেমনি আবার লোকগীতি থেকে প্রেরণা পেয়েছেন সুর সৃষ্টিতে। প্রচণ্ড জেদি আর একরোখা মনের এই মানুষটির জীবন ছিলো বৈচিত্র্যে ভরপুর।

একবার আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে সলিল চৌধুরী গিয়ে সাধারণ জামাকাপড় পড়ে একটা মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্টের দোকানে গেলেন। গিয়ে একটা সেতার দেখতে চাইলেন। কিন্তু দোকানের সেলস গার্ল গড়িমসি শুরু করলো সেটি নামাতে, কারণ সেতারটা বেশ উঁচুতে রাখা। ওইদিকে সলিল চৌধুরীও নাছোড়বান্দা। তিনিও দেখবেন। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছালো যে, দোকানের মালিক এসে শুনতে চাইলেন কি হলো। পুরোটা শুনে সেতারটা নামানো হলো। তারপর সলিল চৌধুরী বাজাতে শুরু করলেন। প্রায় আধঘণ্টার মতো বাজালেন। দোকানে মানুষের ভিড় জমে গেলো। বাজানো শেষে দেখলেন সেলস গার্লের চোখে পানি। দোকানের মালিক বললেন আমি রবি শংকরের বাজনা শুনেছি, কিন্তু আজকে আমি যেটা শুনলাম, সেটা রবি শংকরের চেয়ে কম কিছু নয়। এই সেতারটাকে বক্স সেতার বলে, এটা সবাই বাজাতে পারে না। সলিল চৌধুরী বলেন- আমরা বলি সুরবাহার। দোকানের মালিক ডেভিড জানতে চাইলেন, তিনি কিভাবে সাহায্য করতে পারেন? সলিল চৌধুরী বললেন- তিনি সেতারটা কিনতে চান। ডেভিড বললেন আমি আপনাকে এই সেতারটা উপহার দিচ্ছি। সেই সেতারটা ভারতে নিয়ে এসে তিনি কম্পোজ করলেন ‘না যেয়ো না রজনী এখনও বাকি’, যা লতার কণ্ঠে আরও মানুষের মুখে ঘুরে ফিরে।

সলিল চৌধুরীর এক ভক্তের গল্প বলি এবার।

শচীন দেব বর্মণের খুব আফসোস ছিল ছেলে পঞ্চমকে (রাহুল দেব বর্মন) নিয়ে। তার কারণটাও আবার সলিল চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর যেখানেই প্রোগ্রাম হতো, পঞ্চম সেখানে থাকবেন তো থাকবেনই। শচীন দেব বর্মণ তার জবানিতে বলেছেন সলিলকে, “জানোস, আমার সুর মনে ধরে না আমার পোলাডার। ও পাগল তর সুরে। বার বার শুইনতে থাকে তর গান। আমারেও মানে না। পারিস তো এট্টু বোঝাস পঞ্চমরে।’’

তার সুরে গায়নি ওই সময়ে এমন একজন বিখ্যাত শিল্পী পাওয়া দুষ্কর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, মুকেশ, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সহধর্মিণী সবিতা চৌধুরী, কন্যা অন্তরা চৌধুরী, হৈমন্তী শুক্লা, অনুপ ঘোষাল, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, সুবীর সেন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, সুলক্ষণা পণ্ডিত, অমিত কুমার, রানু মুখোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী, উৎপলা সেন, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, ঊষা মঙ্গেশকর, নির্মলেন্দু চৌধুরী, বিশ্বজিৎ (কোলকাতার চিত্রনায়ক, ‘যায় যায় দিন’ নামের গান গেয়ে পরিচিতি পান), ঊষা উত্থুপ, এমনকি সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন এবং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত।

বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পর যদি ভার্সেটাইল কোন গুণী মানুষ এসে থাকেন, তবে তার নাম সলিল চৌধুরী। জীবনের থেকে সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষটিই হলেন সলিল চৌধুরী।

সলিলে অত্যন্ত মুগ্ধ ছিলেন মান্না দে। আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মান্না দে সিলিল চৌধুরী সম্পর্কে বলছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পরে এমন সংগীত স্রষ্টা আর আসেননি। অত্যন্ত শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র এবং সংগীতমনস্ক মানুষ এই সলিল চৌধুরী। সহজাত সুরের সূক্ষ্ম জ্ঞান ছাড়াও অত্যন্ত শক্তিশালী ওর লেখার হাত। সুরকার এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে সলিল বাবুর স্থান ছিলো একেবারে আলাদা। অসাধারণ সব সুরের সঙ্গে ওর অনন্য সুরের অর্কেস্ট্রেশন এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতো ওর সকল সৃষ্টিকে। সলিল চৌধুরীর স্থান কেউ কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না।’’

সলিল চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন, “আমি জানি না, কোনটা নিয়ে চলবো- কবিতা, গল্প লেখা, অর্কেস্ট্রেশন, না ফিল্মের গান কম্পোজ করা। ক্রিয়েটিভিটি নিয়েই আমার কাজ। যখন যেটা সেই মুহূর্তটায় বা আমার মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খায়, সেটা নিয়ে কাজ করি।”

এতো প্রতিভা এতো অবদান, কিন্তু যদি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির কথা বলি, তবে সেটা বলতে গেলে তিনি পাননি, সেটা রাজ্য থেকে রাষ্ট্রীয়। পুরষ্কার না পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, “আমার কোনো খেদ নেই জানো। গান আমাকে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসা পাইয়ে দিয়েছে। কতো কিছুই পাইনি, শেষে সব ভুলে যাই যখন কেউ আমার গান শুনে বলে আপনি চোখে জল এনেছেন। আমি কোথাকার কে ভাই, ঈশ্বরের যিনি বরপুত্র, সেই মোৎজার্ট সারা জীবনে কী পেয়েছিলেন- বঞ্চনা, বঞ্চনা আর বঞ্চনা।”

তিনি আজও যেভাবে মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছেন এবং তার সৃষ্টি আজও যেভাবে মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত একই আবেদন নিয়ে চলছে, তা সংগীত ইতিহাসে বিরল। আজকের এই শুভক্ষণে জন্মদিনের শুভেচ্ছা সুরের বরপুত্রকে। শুভ জন্মদিন সলিল চৌধুরী।

Comments

The Daily Star  | English

Foreign fruits turn costlier for duty hike

Recent supplementary duty (SD) hikes on the import of fruits have dealt a fresh blow to people who were already cutting back on these delicacies since the imposition of regulatory duties in mid-2022..On January 9, the National Board of Revenue (NBR) increased the supplementary duty on the

2h ago