‘গান না থামিয়ে আমি মাছিটা গিলে ফেললাম’
চার বছর বয়সে গান শেখা শুরু, ছয় বছর বয়সে প্রথম স্টেজে গান পরিবেশন, নয় বছর বয়সে আন্তঃস্কুল সংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। সেই প্রতিযোগিতায় বাজিমাত অর্থাৎ প্রথমস্থান অধিকার। মাত্র বারো বছর বয়সে প্রথম প্লেব্যাক করেন পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে। সেটিও ১৯৬৫ সালের কথা। সেই যে শুরু, চলছে এখনো। তার কণ্ঠের জাদু দিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো উপমহাদেশের কোটি দর্শককে এখনো সুরের আবেশে ভাসিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর তৎকালীন সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন এই গুণী শিল্পী। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনের ঠিক আগ মুহূর্তে ফোনে কথা হয় শিল্পীর সঙ্গে। তার পুরোটাই তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
জানতে ইচ্ছে করছে কে এই মহান শিল্পী? তিনি আর কেউ নন। তিনি সংগীতের রানী রুনা লায়লা। জীবনের ৫৫ বছর, সংগীত নিয়েই আছেন।
কেমন লাগছে এই যে এতো দীর্ঘ সময় ধরে গান গেয়ে যাচ্ছেন?
“এ এক বিশাল সফর। এতো দীর্ঘ সময় ধরে গান গাইতে পারা সত্যিই আনন্দের। এতোটা সময় ধরে শ্রোতারা আমার গান শুনছেন, আমাকে ভালোবাসে যাচ্ছেন, আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। সত্যিই এটা দারুণ ব্যাপার।”
“জীবনে অনেক পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি, প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। আমি সত্যিই সবার কাছে ঋণী, খুব বেশি ঋণী। যতোদিন যাচ্ছে আমার প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর সম্মান যেনো ততোই বাড়ছে। আমি জানি না মানুষের এই ভালোবাসার প্রতিদান কীভাবে দিবো!”
এই যে এতো দীর্ঘ সময় ধরে গান গাচ্ছেন, কোনো আক্ষেপ আছে কি?
“একজন শিল্পীর সব সময়ই একটা আক্ষেপ থাকে। একটা গানকে হয়তো আরও ভালোভাবে গাওয়া যেতো। এখনো প্রায়ই ভাবি, আজ থেকে বিশ বছর আগে বা চল্লিশ বছর আগের গানটা ঐভাবে না গেয়ে অন্যভাবে গাওয়া যেতো। পছন্দের শিল্পীর গান শুনলে মনে হয় আমি হলে এটা কীভাবে গাইতাম। এধরনের অনেক আক্ষেপ তো থাকেই। তারপরেও বলবো আমি আমার ভক্ত-দর্শক শ্রোতাদের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা এখনো আমার গান শুনছেন।”
আপনি তো পাকিস্তান ও ভারতের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন?
“আমি উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে গান করেছি। সবাই আমাকে ভালোবেসেছেন। লতাজী (লতা মুঙ্গেশকর), আশাজী (আশা ভোঁসলে) তো আমাকে তাদের পরিবারেরই একজন মনে করেন। আমাকে স্নেহ করেন, সম্মান করেন, ভালোবাসেন। আমার জীবনের এ এক পরম পাওয়া।”
“যেহেতু পাকিস্তানে অনেকদিন যাওয়া হয় না তাই অনেকের সঙ্গে দেখা হয় না। তবে এখন ফেসবুক, টুইটার আর হোয়াটসআ্যপের কল্যাণে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। আর বাইরে কোনো প্রোগামে গেলে তো কথা হয়-ই।”
যেহেতু লতাজীর কথা আসলো, উনি তো সাম্প্রতিক সময়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আপনি কি যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন?
“প্রতিদিনই যোগাযোগ হচ্ছে লতাজীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। এইতো কিছুদিন আগে মুম্বাই গিয়েছিলাম, তখন লতাজী আমাকে সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু, শারীরিক অসুস্থতার কারণে দেখা করতে পারেননি।”
“লতাজী অসুস্থ, আমি দোয়া করছি যেনো তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন। আমার জন্মদিনে তিনি সব সময় বিভিন্ন ধরনের উপহার পাঠাতেন। আমাকে ভালোবাসা জানাতেন।”
সময়ের পরিক্রমায় বাংলা গানের আবেদন কি দর্শকদের কাছে কমে গেছে?
“আমরা যখন গান শুরু করি তখন খুব পরিশ্রম করে একটা গান গাইতাম। চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক, ছবির পরিচালক, গীতিকার, সুরকার সবাই একসঙ্গে বসে একটি গান তৈরি করতেন। তারপর সেই গান মিউজিকের সঙ্গে কয়েক দফা রিহার্সেল হতো। শিল্পী কয়েকদিন রিহার্সেল করতেন। তারপর রেকর্ডিং হতো। যেহেতু লাইভ রেকর্ডিং হতো তাই সবাইকে খুব পরিশ্রম করতে হতো একটি গান তৈরি করতে। হয়তো সন্ধ্যায় বসেছি, কিন্তু, ভোর হয়ে গেছে শুধু একটি গানই রেকর্ড করতে। মোট কথা, পরিশ্রমটা করেছি এবং এর মধ্য দিয়েই শিখেছি। এই কারণেই বোধ হয় এখনো মানুষ আমাদের সময়ের গান শুনছেন এবং গাচ্ছেন।”
“সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন সবকিছুই খুব দ্রুত হয়ে গেছে। এখন আর কেউ সময় নিয়ে কাজ করতে চান না। সবারই তাড়াহুড়া। কাট-পেস্ট করে গানে সুর লাগাচ্ছেন। যার কারণে গানে ইমোশন ও ফিলিং অনেক কমে গেছে। গানে প্রাণের অনেক অভাব। মোট কথা, গানের আবেদন ও কাজের মান অনেক কমে গেছে।”
“আমরা বছরের পর বছর ওস্তাদদের কাছে গান শিখেছি। গুণী শিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সংগীত পরিচালকদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখেছি। কিন্তু, দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমাদের দেশেও মেধাবী ছেলেমেয়ে রয়েছে। কিন্তু, যথাযথ প্ল্যাটফর্ম না থাকার কারণে তারা ঠিকমতো বিকশিত হচ্ছে না। আরেকটা কারণ হলো, এখন ভালো গুরু বা ওস্তাদেরও অভাব রয়েছে এই দেশে। সব মিলিয়ে সংকট তো আছেই।”
গান নিয়ে মজার কোনো স্মৃতি যা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে?
“আমি তখন পাকিস্তানে। লাহোরের বারি স্টুডিওতে একবার প্লেব্যাক করতে গিয়েছিলাম। টেক চলছে। যেহেতু সেসময় সব গান লাইভ রেকর্ডিং হতো সবাইকে খুব সতর্ক থাকতে হতো কারো যেনো ভুল না হয়। কারণ একজনের ভুলের কারণে সবাইকে মানে সব বাদ্যযন্ত্রী, শিল্পী, রেকর্ডিস্ট সবাইকে গানটা আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। তো হঠাৎ দেখি সিঙ্গার বুথে একটি মাছি উড়ছে। গানের একটি অংশে হামিং ছিলো। যেই না আমি ‘আ-আ-আ’ টান দিয়েছি, অমনি মাছিটা আমার মুখে ঢুকে গেলো। আমি জানি, এখন যদি গান বন্ধ করে দেই তবে আমাকে সহ সবাইকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। এদিকে, গানটা প্রায় শেষের দিকে। তাই গান না থামিয়ে আমি মাছিটা গিলে ফেললাম এবং গান শেষ করলাম। এই কথা মনে হলে আমি এখনো মনে মনে হাসি।”
জন্মদিনের শুভেচ্ছা। কীভাবে কাটাবেন দিনটি?
ধন্যবাদ আপনাকে। বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। পারিবারিকভাবেই সময় কাটাবো।
জন্মদিনে চাওয়া কী?
“পৃথিবীতে সব যুদ্ধ, হানাহানি বন্ধ হবে। সবার শান্তি হোক। পৃথিবীটা হোক ভালোবাসার। পৃথিবীটা হোক সুরের পৃথিবী।”
Comments