৭১তম জন্মদিনে হুমায়ূন আহমেদ
নন্দিত লেখক, জনপ্রিয় নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকার, হিমু ও মিসির আলীর স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদের ৭১তম জন্মদিন আজ (১৩ নভেম্বর)। জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার। বাংলাদেশে তার মতো জনপ্রিয় লেখক কমই এসেছেন। সৌভাগ্যের সোনার কাঠি নিয়ে জন্ম নেওয়া একজন লেখক তিনি। লেখালেখি ছাড়া নাটক ও সিনেমা, যেখানেই নাম লিখিয়েছেন, সাফল্য তাকে ছুঁয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর পর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাস দুটি দিয়ে তার যাত্রা শুরু সাহিত্য জগতে। উপন্যাস দুটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে যায় দ্রুত। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো আগমন ঘটে তার। মধ্যবিত্ত ঘরে তিনি লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান।
‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামে মুক্তিযুদ্ধের বড় ক্যানভাসের উপন্যাস রয়েছে হুমায়ূনের। এটি দিয়েছে ব্যাপক খ্যাতি।
জীবদ্দশায় দুই শতাধিক উপন্যাস লিখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার নতুন উপন্যাস মানেই ছিলো বিক্রির তালিকায় সেরার অবস্থানে। হিমুবিষয়ক বই মানেই পাঠকের হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো অবস্থা। মিসির আলী ছিলো তার সৃষ্ট আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র।
‘কোথাও কেউ নেই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কবি’, ‘বাদশা নামদার’ ইত্যাদি কতো কতো উপন্যাস, যা পাঠকদের মনকে ছুঁয়ে গেছে।
তাকে বলা হতো কথার জাদুকর। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ নাট্যকার হিসেবেও ছিলেন প্রবল জনপ্রিয়।
এদেশে কেবলমাত্র হুমায়ূন আহমেদের লেখা নাটকের জন্যই রাজপথে মিছিল হয়েছে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইকে যখন ফাঁসি দেওয়া হবে তখনই ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় মিছিল হয়েছিলো বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যেনো না দেওয়া হয়।
টেলিভিশনে মানুষকে নাটকমুখি করার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের তুলনা তিনি নিজেই। একইভাবে দেশি লেখকের বইয়ের পাঠক সৃষ্টিতেও বিশাল অবদান রয়েছে তার।
এক সময়ে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন। সেখানেও সফলতা আসে। প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে জয় করে নেন সিনেমাপ্রেমীদের মন। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমাটিও এদেশের সফল সিনেমার একটি। সবশেষ পরিচালনা করেন ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।
৭১তম জন্মদিনে হুমায়ূন আহমেদ উপস্থিত নেই তার ভক্তদের কাছে। কিন্তু, রয়ে গেছে তার হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই- আর কতো সৃষ্টি!
জোছনার প্রতি ছিলো হুমায়ূন আহমেদের অসম্ভব রকমের ভালোবাসা। শহরের মানুষকে তিনি জোছনার প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন নাটক ও উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। ‘জোছনা বিলাস’ নামে রয়েছে তার উপন্যাস। জোছনা ও বৃষ্টির প্রতি ছিলো তার টান। ‘বৃষ্টি বিলাস’ নামেও তার উপন্যাস রয়েছে। নুহাশপল্লীতে একটি ঘরের নাম তিনি রেখেছিলেন বৃষ্টি বিলাস।
নন্দিত লেখক-নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের রয়েছে আলোচিত কিছু চরিত্র। সেসব চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তারা স্মৃতিচারণ করেছেন তাকে।
বাকের ভাই: ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্রের নাম বাকের ভাই। পরে এই উপন্যাসটি অবলম্বনে ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়। বিটিভিতে প্রচারিত হয় নাটকটি। বিটিভির ইতিহাসে আলোচিত কয়েকটি নাটকের একটি ‘কোথাও কেউ নেই’। একইভাবে এই নাটকে বাকের ভাই নাটকের ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী চরিত্র। কোনো নাটকের চরিত্রকে কেন্দ্র করে এতো সাড়া কখনো এই দেশে পড়েনি। নাটকে বাকের ভাইকে যখন ফাঁসি দেওয়া হবে, সে সময়ে ঢাকাসহ দেশে বেশ কয়েকটি স্থানে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিলো। বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে তারকাখ্যাতি পান আসাদুজ্জামান নূর। আজও এদেশের নাটকপ্রেমীরা মনে রেখেছেন বাকের ভাই চরিত্রটিকে। আসাদুজ্জামান নূর এ বিষয়ে বলেন, “আমার অভিনয় জীবনের সেরা একটি কাজ ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি। হুমায়ূন আহমেদ নিখুঁতভাবে বাকের ভাই চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন।”
মিসির আলী: নাটক ও চলচ্চিত্রে রূপদানের আগে পাঠকরা মিসির আলী নামের সঙ্গে পরিচয় হন উপন্যাসের মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদ তার মিসির আলীকে নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন। মিসির আলী চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক- মিসির আলী যুক্তি দিয়ে যেকোনো বিষয়ের সমাধান করেন। একসময় মিসির আলীকে নাটকে নিয়ে আসেন হুমায়ূন আহমেদ। এ চরিত্রে অভিনয় করেন প্রয়াত আবুল খায়ের, আবুল হায়াত, আশীষ খন্দকার প্রমুখ। সবশেষে মিসির আলী চরিত্রে রূপদান করেন চঞ্চল চৌধুরী। সেটা ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে। ‘দেবী’তে মিসির আলী চরিত্রটি আরও জনপ্রিয়তা পায়। ‘দেবী’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো আশির দশকে, অবসর প্রকাশনী থেকে। আশির দশক থেকে আজও মিসির আলী তুমুল জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। মিসির আলী চরিত্রটিতে চঞ্চল চৌধুরী অভিনয় করার পর এখন অনেকেই তাকে মিসির আলী নামে ডাকেন। চঞ্চল চৌধুরী বলেন, “মিসির আলী অত্যন্ত পাঠক নন্দিত একটি চরিত্র। সেই চরিত্রটি করা আমার জন্য ছিলো অনেক চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। তারপরও শেষমেশ করেছি। মিসির আলী চরিত্রটি আমার অভিনয় জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।”
হিমু: এখনো হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে হিমুর অবস্থান প্রথমে। হিমুর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদিও হিমুবিষয়ক নতুন কোনো উপন্যাস পাঠকরা আর কোনোদিনও পাবেন না। কিন্তু, হিমুকে অনুসরণ করে এখনো একুশে বই মেলার সময়ে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়ান অনেকে। এখনো বিভিন্ন সময় শহরে কখনো কখনো হিমুর দেখা মেলে। হিমুকে নিয়ে প্রথম লেখা উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’। অনন্যা থেকে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিলো আশির দশকে। সেই থেকে হিমুকে নিয়ে যতো উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে সবগুলি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছে। হিমুকে নিয়ে কোনো সিনেমা এখনো হয়নি। নাটক হয়েছে, কিন্তু তা সংখ্যায় খুবই কম। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘আজ রবিবার’ নাটকটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো সেই সময়ে। ওই নাটকে হিমুকে দেখা গেছে প্রধান একটি চরিত্রে। ‘আজ রবিবার’ নাটকে হিমুর চরিত্রে অভিনয় করেন তুহিন।
শুভ্র: হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে শুভ্র অন্যতম। শুভ্রকে উপন্যাসেই বেশি দেখা গেছে। তাকে দেখা গেছে একটি সিনেমাতেও। সিনেমাটির নাম ‘দারুচিনি দ্বীপ’। তৌকীর আহমেদ পরিচালনা করেন সিনেমাটি। এতে শুভ্র চরিত্রে অভিনয় করেন চিত্রনায়ক রিয়াজ। রিয়াজ বলেন, “হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। সিনেমাও করেছি কয়েকটি। অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। শুভ্র চরিত্রটিকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। শুভ্র চরিত্রটি করার পর তিনি বেশ প্রশংসা করেছিলেন। ওইরকম করে প্রশংসা কম মানুষই করেছেন।”
মফিজ পাগলা: ‘সবুজ ছাতা’ নাটকে মফিজ পাগলা চরিত্রটিও সেসময়ে খুব আলোচিত হয়েছিলো। মফিজ পাগলা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে সবার কাছে মফিজ পাগলা নামে পরিচিতি পান জাহিদ হাসান। জাহিদ হাসান বলেন, “একটা সময়ে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। তার অনেকগুলো ধারাবাহিকে অভিনয় করেছি। তার সঙ্গে সিনেমাও করেছি। প্রতিটি চরিত্র তিনি যত্ন করে লিখতেন এবং পরিচালনা করতেন। তবে, মফিজ পাগলা চরিত্রটির জন্য বেশি ভালোবাসা পেয়েছি মানুষের কাছ থেকে। আজ প্রিয় মানুষটি নেই, কিন্তু তার করা কাজগুলো রয়ে গেছে।”
Comments