জাবি ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দল ও সংঘর্ষের নেপথ্যে ৪৫০ কোটি টাকার নির্মাণ কাজ
একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আবারও আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্রলীগ। এবার সংবাদের শিরোনাম ‘গায়ে ধাক্কা’ লাগার জেরে ছাত্রলীগের দুই হলের নেতাকর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। গত ৩ জুলাই আহত হয়ে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭০ জনের বেশি নেতাকর্মী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত নয় মাসে কমপক্ষে সাতটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ‘সিনিয়রকে সম্মান না করা’, ‘খেলার মাঠে স্লেজিং’, ‘ইভটিজিং’, ‘কথা-কাটাকাটি থেকে মারধর’ যেমন ছিলো, তেমনি নিয়োগ ‘বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি’, ‘অন্তঃকোন্দল’ ও ‘আধিপত্য বিস্তার’কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। ঘটনাগুলো ঘটেছে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে।
এর মধ্যে তিনটি বড় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে- যেখানে শিক্ষক, সাংবাদিক, পুলিশসহ ছাত্রলীগের প্রায় দেড়শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এতে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে কমপক্ষে ২০ রাউন্ড গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করা, রামদা, রড, জিআই পাইপ ও চাপাতির মতো দেশি অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
বারবার গোলাগুলি ও অস্ত্রের ঝনঝনাটিতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। হুমকির মুখে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ। আবাসিক হলগুলোতে দেশি অস্ত্রের মজুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র থাকার অভিযোগের পরও প্রশাসন কেনো তা উদ্ধারে তৎপর হচ্ছে না তা রহস্যজনক, মন্তব্য করছেন অনেকে।
কিন্তু, কেনো বারবার এমন সংঘর্ষ? যেখানে প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের কর্মকাণ্ড নেই, সেখানে কেনো পিস্তল-দা-চাপাতি নিয়ে সংঘর্ষ?
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্বের দুর্বলতা, গ্রুপিং, টেন্ডারের ভাগাভাগির ঠিক মতো না হওয়া, হল কমিটি না থাকা, চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়াকে দায়ী করেছেন ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে গত ২৩ অক্টোবর ১,৪৪৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পের বড় ধরনের কাজের মধ্যে রয়েছে- ছেলেদের ৩টি ও মেয়েদের ৩টি আবাসিক হল, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, ছাত্র-ছাত্রীদের খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, আবাসিক কমপ্লেক্স, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, লেকচার থিয়েটার হল ইত্যাদি।
এই প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের জন্য গত ১ মে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিলো। হলগুলো নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। এতে ছয়টি হলের টেন্ডার প্রক্রিয়া ও উদ্বোধন ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে ছাত্রলীগের অন্তঃকলহ আরো প্রকট হয়ে উঠেছে বলে ছাত্রলীগের সূত্রে জানা যায়।
জাবি ছাত্রলীগে বর্তমানে গ্রুপ রয়েছে তিনটি। সভাপতি মো. জুয়েল রানা ও সাধারণ সম্পাদক চঞ্চলের নেতৃত্বে একটি করে গ্রুপ এবং যুগ্ম-সম্পাদক মো. সাদ্দামের হোসেনের নেতৃত্বে আরেকটি। সাদ্দামের গ্রুপটি মূলত জাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদ রাসেলের। অভিযোগ রয়েছে প্রায় ৬০ লাখ টাকার কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে দূরত্ব তৈরি হয় চঞ্চল ও রাজিবের। তখন থেকে ১নং যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে ওই গ্রুপের দেখভাল করেন সাদ্দাম হোসেন ও সহ-সভাপতি নিয়ামুল তাজ। গ্রুপটি মূলত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল কেন্দ্রিক।
সম্প্রতি টেন্ডারের ‘ভাগবাটোয়ারা না পাওয়ার’ আশঙ্কায় মওলানা ভাসানী হল ছাত্রলীগের একাংশ যোগ দিয়েছে সাদ্দাম হোসেনের গ্রুপে। এতে মওলানা ভাসানী হলের সঙ্গে ছাত্রলীগের সম্পাদক চঞ্চলের দূরত্ব তৈরি হয়। সাদ্দামের গ্রুপটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহী গ্রুপ হিসেবেও পরিচিত। এই বিদ্রোহী গ্রুপের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার তদবিরের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু, তেমন সুবিধা করে উঠতে পারেনি। তাদের অভিযোগ, প্রশাসন ছাত্রলীগের সেক্রেটারিকে সুবিধা দিচ্ছে।
টেন্ডার প্রক্রিয়ার শুরুতেই বেশ কয়েকটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি তাদের শিডিউল ছিনতাইয়ের অভিযোগ তোলেন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ‘ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগপত্রে তারা বলেন, “গত ২৩ মে শিডিউল কিনে ফেরার সময় ছাত্রলীগের পরিচয় দিয়ে ২০-৩০ জন যুবক তাদের কাছ থেকে শিডিউল ছিনিয়ে নিয়েছে।”
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানান, ওইদিন দুপুর ২টার দিকে তাদের একজন প্রতিনিধি নির্ধারিত অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাম্পাস শাখা থেকে শিডিউল ক্রয় করেন। ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের পাশে ২০-২৫ জনের একটি দল নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা ও সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ান চঞ্চলের অনুসারী পরিচয় দিয়ে শিডিউল ছিনিয়ে নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের এক নেতা জানান, “ছয়টি টেন্ডারের মধ্যে পাঁচটি কোন কোন প্রতিষ্ঠান পাবে তা ইতোমধ্যে নির্ধারিত হয়েছে। জানা যায়, এর মধ্যে একটি টেন্ডার পেয়েছে ছাত্রলীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার আত্মীয়ের প্রতিষ্ঠান। বাকি টেন্ডারটি কে পাবে তা নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে মতোবিরোধ চলছে বলেও জানা যায়।”
ছাত্রলীগ সভাপতি মো. জুয়েল রানার বিরুদ্ধে ‘মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে শিডিউল নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যদিও সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন সভাপতি মো. জুয়েল রানা।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “শিডিউল ছিনতাইয়ের সঙ্গে ছাত্রলীগ কোনোভাবেই জড়িত নয়। টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং উন্নয়ন প্রকল্প সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে আমরা সহযোগিতা করছি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার জায়গা থেকে ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে ওসব করে থাকতে পারে।”
ক্যাম্পাসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন কাজের ভাগ কেন্দ্রিক জটিলতায় জাবি ছাত্রলীগ বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায় নীরব দর্শক হয়ে থাকছে।
‘যথাযথ বিচার’ না হওয়া এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। তারা বলেন, অপরাধের শাস্তি না হওয়ায় ‘কিছুই হয় না’- এমন মনোভাব বিরাজ করছে। ফলে অপরাধ, সংঘর্ষ বাড়ছে।
কখনো শুধু ‘তদন্ত কমিটি’ করেই দায় এড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ একে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘চা কমিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৩ জুলাইয়ের সংঘর্ষের ঘটনায় তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন। সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় অধ্যাপক রাশেদা আখতারকে প্রধান করে শুধুমাত্র পাঁচ-সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দশ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে জাবি ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শহীদ সালাম বরকত হলে আক্রমণ করে। এতে দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। সেদিন ছাত্রলীগের এক সহ-সভাপতি ও এক সম্পাদক পদধারীকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। পহেলা ফাল্গুন সন্ধ্যায় গণমাধ্যম কর্মীরাসহ অনেকেই সেই দৃশ্য দেখেন।
এই ঘটনায়ও উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নূরুল আলমকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু, ওই তদন্তের প্রেক্ষিতে এখনও কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম বলেন, “প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে জমা দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”
এবারের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রশাসন ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছে ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী।
সংঘর্ষের বিষয়ে ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. সাদ্দাম হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরিবর্তে প্রশাসনের ভূমিকা ছিলো রহস্যজনক। আর প্রক্টরের আচরণও ছিলো পক্ষপাতিত্বমূলক। প্রশাসন বিন্দুমাত্র থামানোর চেষ্টা করেনি। আড়াই-তিন ঘণ্টার মধ্যে কোনো পুলিশ আসেনি।”
ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে সাদ্দাম বলেন, “ওই ঘটনায় জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদকের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সংঘর্ষ দীর্ঘস্থায়ী করতে ওখানে সাধারণ সম্পাদক নিজে এসে উস্কানি দিয়েছে। গত তিন মাস সে ক্যাম্পাসে ছিলো না। ক্যাম্পাসে এসে প্রক্টরের সঙ্গে মিটিং করেছে। প্রক্টরের সঙ্গে তার সখ্যতা রয়েছে। ক্যাম্পাসে ৪৫০ কোটি টাকার কাজ চলছে, সেখান থেকে বাকিদের মনোযোগ সরাতে এই ঘটনা দীর্ঘ করা হয়েছে। প্রশাসন হয়ত সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে ডিলিংয়ে গেছে।”
জাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “প্রশাসন একপাক্ষিক আচরণ করেছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। কিন্তু, প্রক্টরের নির্দেশে পুলিশ আমাদের দিকেই টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। প্রশাসনের এরকম পক্ষপাতমূলক আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ।”
উস্কানির বিষয়ে ছাত্রলীগের সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “উস্কানি দিলেতো ওখানে যাওয়ার দরকার ছিলো না। পোলাপান কথা না শুনলে কী করতে পারি! বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যাঞ্জাম করাতো ভালো না। আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। এখন যে অভিযোগ করছে তা ভিত্তিহীন।”
প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, “গতকালের (৩ জুলাই) ঘটনা অপ্রত্যাশিত। এ ধরণের ঘটনায় অভিযোগ উঠতেই পারে। আমি ঘটনাস্থলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হই। আমাদের কাজের কোনো গাফিলতি ছিলো না। কয়েকবার ঘটনা থামানোর চেষ্টা করার পরও ঘটনার পুনরাবৃত্তি রহস্যজনক! আমি কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপকে প্রমোট করি না, করবোও না। কেউ আমার কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা চাইবে না, এটাই আমার প্রত্যাশা।”
জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে গোপন মিটিংয়ের অভিযোগ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ. স. ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, “আমার দরজা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্যই খোলা। যে কেউ আমার কাছে আসতে পারে। আমার দায়িত্ব হলো সাধ্যমতো তাদের সমস্যার সমাধান করা। কিছুদিন আগে সেক্রেটারি (আবু সুফিয়ান চঞ্চল) আমার কাছে আসছিলো উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে। আমি তাকে এ বিষয়ে একটু সহযোগিতা করি। এর বেশি কিছু না। এটাকে যদি ‘গোপন মিটিং’ বলে তাহলে তো ঠিক না। ঔদিন তো আমার কাছে তারেক ও মিজান (ছাত্রলীগ নেতা) আসছিলো। ওরাও তো অনেক সময় ছিলো।’’
উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ, স, ম, ফিরোজ উল হাসান এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়িও উত্তরবঙ্গে হওয়ায় ছাত্রলীগের একাংশ বিভিন্ন সময় প্রক্টরের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগে গ্রুপিংয়ের অভিযোগ আনেন।
গত বছরের ২ অক্টোবর ইভটিজিংকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মীর মশাররফ হোসেন হল ও আল বেরুনী হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আহত হন কমপক্ষে ৩০ জন নেতাকর্মী এবং একটি মোটর সাইকেলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায়ও মীর মশাররফ হোসেন হলের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়।
এ ঘটনার বিচারের দাবিতে গত ৫ অক্টোবর সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার হলে তালা লাগিয়ে দেন আল বেরুনী হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ পরিস্থিতিতে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের উপক্রম হলে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে তারা সরে যান। এতে নির্দিষ্ট সময়ের ৩০ মিনিট পরে জীববিজ্ঞান অনুষদের ‘ডি’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু, এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করেনি।
গত এপ্রিলে জাবিতে খেলতে আসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল দলের উপর হামলা ও আগের দিন অস্ত্র ঠেকিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো জমা দেননি অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান করে গঠিত হওয়া কমিটি।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কমিটির মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছে। মাঝখানে ছুটি ছিলো। আমাদের কিছু ফাইন্ডিংস হাতে আসছে। আরও একটা মিটিং লাগবে, তারপর আমরা জমা দিয়ে দেবো।”
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে টেন্ডার ছিনতাইয়ের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরও এ ঘটনায় প্রশাসনকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
গত ১ এপ্রিল ছিনতাইয়ের অভিযোগে আটক হওয়া পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করে প্রশাসন এবং তদন্ত কমিটি গঠন করে। যার মেয়াদ শেষ হলেও এখনো প্রতিবেদন জমা হয়নি। ওই কমিটির সভাপতি ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এ টি এম আতিকুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা এখন প্রায় ফাইনাল স্টেজে। আমরা সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিলাম। এতে সাক্ষী নিয়ে ঝামেলা থাকে। আর একটু দেখে জমা দিয়ে দেবো।”
সম্মিলিত শিক্ষক সমাজের যুগ্ম আহবায়ক অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, “সারাদেশেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। যা অপরাধীদেরকে অপরাধ করতে প্রত্যক্ষ মদদ যোগায়। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষের ঘটনার আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। গতবছরের অক্টোবরে সংঘটিত যৌন হয়রানির ঘটনায় এমনকি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। এই ঘটনাতেও ছাত্রলীগের নাম পত্রিকায় এসেছে। এ ধরনের শৈথিল্য নজির হিসেবে নিন্দনীয়। সংশ্লিষ্ট সকলে এ ধরনের নজির থেকে ভুল বার্তা পান যে, অপরাধ করলেও পার পেয়ে যাওয়া সম্ভব।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, “গত ৩ জুলাইয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আহত হয়েছেন। অতীতের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায়, পুনরাবৃত্তি ঘটছে। দ্রুততার সঙ্গে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনে প্রতি আহবান জানাচ্ছি।”
এ বিষয়ে ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ দিদার বলেন, “ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয় যে তদন্ত কমিটি করে তা হয় ‘চা নাশতা’ কেন্দ্রিক। এতে অপরাধীরা খুব সহজেই পার পেয়ে যায়।”
এ বিষয়ে সদ্য বিদায়ী প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, “ওইদিন (৩ জুলাই) প্রকাশ্যে যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে, এটি আসলে শঙ্কার বিষয়। আমি এ বিষয়ে আমাদের প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছি। তারা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিবেন। যে কোনো সময় যে কোনো হলে রেইড হতে পারে। আর এটার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার।”
এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনি সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আরিফুল ইসলাম আরিফ বলেন, “দীর্ঘদিন যাবৎ হল কমিটি না থাকার কারণে সাংগঠনিক অবস্থা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, নেতৃত্বের চেইন-অব-কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। অতিসত্বর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত ৩ তারিখের ঘটনায় কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে চার সদস্যদের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তি করে খুব শীঘ্রই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’’
উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের অনেক তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু এইসব তদন্তের দীর্ঘ সূত্রিতা রয়েছে। অনেক সময় শিক্ষকরা ব্যস্ততা দেখিয়ে দায়িত্ব নিতে চান না। ইতিমধ্যে যেসব তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে এসেছে তা একটি আলাদা সিন্ডিকেট ডেকে আমরা বিচার করবো।”
তিনি আরো বলেন, “হলগুলোতে পুলিশি তল্লাশি চালানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। এটা আমরা ঘোষণা দিয়ে করবো না। যেকোনো সময় আমরা তল্লাশি চালাবো।”
মো. আসাদুজ্জামান, দ্য ডেইলি স্টারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা
asadju43@gmail.com
Comments