ভোট সুষ্ঠু হলেও মানুষের আস্থা ফেরেনি
বগুড়া-৬ (সদর) আসনে উপ-নির্বাচন সম্পন্ন হলো সুন্দর পরিবেশে। এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে যে খরব তাতে করে বলায় যায় যে গত ১১ বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন, শুধু মানুষের মধ্যে ছিল না কোনো উৎসব বা আমেজ। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা সহজভাবেই ভোটের ফলাফল মেনে নিয়েছেন এবং কারো কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি এখন পর্যন্ত। কোথাও কোনো সহিংসতা, ভোট প্রদানে বাধা, ভোট চুরি, কারচুপি বা ভোটের উপকরণ ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক, মাত্র ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোটার তাদের ভোট প্রদান করেছেন এই নির্বাচনে।
এখন দেখা যাক কি করে এত সুন্দর এবং সর্বজন প্রশংসিত নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হলো এবং তারপরও কেন বেশিরভাগ ভোটার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল না।
১.
সরকারের সদিচ্ছা: সাধারণ মানুষ থেকে প্রার্থী সবাই বলছেন এই সুষ্ঠু ভোটের পিছনে সরকারের সদিচ্ছাই ছিল প্রধান কারণ। বগুড়া নির্বাচন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এই উপ-নির্বাচনে শুধু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। গতবার একটি কেন্দ্রে কেবল মাত্র একজন করে পুলিশ সদস্য ছিলেন এবার সেখানে ছিলেন পাঁচ জন। জাতীয় নির্বাচনে প্রতি আসনে মাত্র ২৪ জন র্যাব সদস্য ছিলেন, এবার সেখানে ১৩০ জন র্যাব সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু বগুড়া নয়, আশপাশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে থেকে আনা হয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। প্রায় তিন হাজারের বেশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবার উপস্থিত ছিলেন এই নির্বাচনে, জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলা এবং নাশকতার অভিযোগে ১৫টির বেশি মামলা করেছিল পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। এসব মামলার আসামী হয়েছিলেন আট হাজারের বেশি লোক। সমান সুযোগ না থাকায় ভালোভাবে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালাতে পারেননি অন্যদলের, বিশেষ করে বিএনপির প্রার্থীরা। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী। এমন কি বেশিরভাগ ভোট কেন্দ্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি বিএনপির কোন পোলিং এজেন্ট।
কিন্তু এই উপ-নির্বাচনের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। এই জন্য সবাই বলছেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশনের কাছে যেন দেশের মানুষের কোনো প্রত্যাশাও নেই। অথচ নির্বাচন করার যাবতীয় কাজ তাদেরই করার কথা। নিজেদের অসততা-অযোগ্যতা নির্বাচন কমিশন এমনভাবে দৃশ্যমান করেছে যে,মানুষ ধরেই নিয়েছে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। নামে নির্বাচন কমিশন হলেও, মানুষ বুঝে গেছে যে সরকারই সবকিছু করে।
২.
কেন এত কম সংখ্যক মানুষ ভোট দিলেন: এত সুন্দর পরিবেশ থাকার পরও, উপ-নির্বাচনে মাত্র ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ মানুষ মানুষ ভোট দিয়েছেন। বগুড়া-৬ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২৭৯ জন। অথচ ভোট পড়েছে মাত্র ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৭০টি। এই আসনে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৪৭৬টি যা মোট ভোটের প্রায় ৬৬ শতাংশ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রায় অর্ধেক ভোটার এবারের উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। এখন কথা হল, সরকার এত সুন্দর পরিবেশ তৈরি করল অথচ ভোটার অর্ধেক কমে গেল কেন? এর প্রধান কারণ হলো গত ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ধাপে ধাপে দেশের সব উপজেলায় (উপজেলা নির্বাচন) ভোট হয়েছে, তাতেও ভোটারদের অভিজ্ঞতা ঠিক জাতীয় নির্বাচনের মতোই ছিল। বিভিন্ন জায়গায় মারামারি, হানাহানি, হামলা-মামলা, হয়রানি এবং সরকার দলীয় প্রার্থীর সুবিধা পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাই জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে পরের নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি কমতে শুরু করেছে। এটা স্পষ্ট, নির্বাচনের যেমন পরিবেশ তাতে ভোটারদের তেমন কোনো আস্থা নেই। ভোটারের আস্থা ফেরাতে হলে সরকারকে (পড়ুন নির্বাচন কমিশন) দৃশ্যমান কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। একজন সাধারণ ভোটারের পক্ষ হয়ে রাতে বা দিনে কেউ ভোট দিয়ে দিবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩.
ইভিএম-এ ভোটারদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া: শুধুমাত্র ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কে ভোটারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য, এই আসনে নির্বাচন কমিশন খরচ করেছে প্রায় অর্ধ-কোটি টাকা, কিন্তু ভোটারদের তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। এই প্রথমবারের মতো, বগুড়া সদরের ১৪১টি কেন্দ্রের সবগুলোতেই ইভিএম-এ ভোট সম্পন্ন হয়েছে কোনো ঝামেলা ছাড়া। এ কথা সত্য যে যারা গতকাল এই মেশিনের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন তারা সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন এই পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া সহজ। পাশাপাশি অনেক ভোটারের এটা বলেও সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, এই মেশিন তো সরকারি লোকজনের হাতে, ভোট যে দিলাম সেটা গ্রহণ হয়েছে কিনা, কিংবা এই ফল যে পরিবর্তন করা যাবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? সব তো সরকারি কর্মকর্তার হাতে!
এখন মোদ্দা কথা হলো সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন সম্ভব, তা এই উপ-নির্বাচনের মাধ্যমেই বোঝা গেল। এও বোঝা গেল কাজটি করছে সরকার, নির্বাচন কমিশন নয়। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সরকারের অবস্থান এমন ছিল না, একটি উপ-নির্বাচনে যা দেখা গেল। ফলে এতে জনআস্থা ফিরবে না।
এই উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে ইভিএমের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এই প্রচেষ্টা কোনো কাজে আসবে না যদি বৃহত্তর ক্ষেত্রে অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে এমন সুন্দর নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা না যায়।
মোস্তফা সবুজ: দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া
Comments