কৃষকের অভিমান বাড়ছে!
ঈদের দিনটি কেটে গেলো। কিন্তু, বাংলাদেশ কৃষকের ঘরে ঘরে এবার সেই ঈদ-আনন্দ ছিলো না। এ বছর কৃষক যে মূল্যে ধান উদপাদন করেছেন তার থেকে অনেক কম মূল্যে তাদের ধান বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে বিঘা প্রতি তাদের ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যখন বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি, কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি তখন তারা অভিমানের সঙ্গে জানিয়েছেন যে তারা আর ধান চাষ করবেন না, অন্য ফসল চাষ করবেন কিংবা চাষাবাদই ছেড়ে দিবেন অথবা কল-কারখানায় কুলি-মজুরের কাজ করবেন, তবুও ধান চাষ করবেন না। কারণ, একজন দিনমজুরের দাম ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা, অথচ এক মন ধানের দাম তার চেয়ে কম।
এখন কথা হলো সত্যিই যদি আমাদের কৃষকরা অভিমান করেন, তবে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কি আর এখনকার মতো থাকবে? আসুন দেখা যাক উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলার কৃষকের অবস্থা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইঙ্গিত দিয়েছেন যে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ধান চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন এবং অন্যান্য ফসল, যেগুলো চাষে কম পরিশ্রম ও খরচ কম হয় কিন্তু দাম ভালো পাওয়া যায়, সেগুলোর দিকে ঝুকে পড়ছেন।
নওগাঁ জেলার ধান চাষীরা ধানের পরিবর্তে আম চাষে ঝুকে পড়েছেন! বগুড়ার কৃষকরা ধানের পরিবর্তে অগ্রিম শাক-সবজি, আলু, কিংবা ভুট্টা চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
নওগাঁর কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন যে গত ১০ বছরে জেলায় ১৮,৬০০ হেক্টর ধানের জমি আম বাগানে পরিণত হয়েছে। ১০ বছর আগে গোটা জেলায় আমের বাগান ছিলো মাত্র ১,৫০০ হেক্টরের কম। যে হারে জেলায় আমের বাগান বাড়ছে তাতে আগামী ৫ বছরে ধানের জমির পরিমাণ তিনগুণ কমে আমের বাগানে পরিণত হতে পারে। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন যে ধান চাষে পানি বেশি লাগে, পরিশ্রম বেশি, ঝুঁকি বেশি কিন্তু লাভ কম। অন্যদিকে আম চাষে পরিশ্রম কম এবং লাভ বেশি। তাছাড়া বরেন্দ্রভূমিতে পানির সংকট তো আগে থেকেই ছিলো, যা কৃষকদের আম চাষের প্রতি আগ্রহী করে তুলছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট চিরদিনের তবুও কৃষকরা এতোদিন ধান চাষ করে আসছিলেন। ধান চাষে লাভ না হওয়ায় এই অঞ্চলের কৃষকরা আম চাষ শুরু করেছেন। গত এপ্রিলে নওগাঁর কয়েকটি উপজেলা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে শত শত শিক্ষিত তরুণ এখন আম চাষের দিকে ঝুকে পড়েছেন।
কৃষি-সম্প্রসারণের তথ্য মতে, বগুড়া জেলায় গত ৮-১০ বছরে ধানী জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর। আগে এসব জমিতে ধান হতো এখন ভালো দামের আশায় কৃষক বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি (বিশেষ করে অগ্রিম) এবং উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ করছেন।
অন্যদিকে এবার বগুড়ায় বোরো ধানের চাষ হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর জমিতে এবং ফলন হয়েছে ৭.৭৮ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর জেলায় বোরো ধানের চাষ হয়েছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে এবং ফলন হয়েছিলো ৭ লাখ ৭৬ হাজার মেট্রিক টন। তার মানে হলো এবার ১৩ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে ধান চাষ হলেও ফলন বাড়েনি এবং গতবারের তুলনায় কমেছে।
বাংলাদেশে বছরে চালের চাহিদা হলো সাড়ে ৩ কোটি টনের কিছু কমবেশি এবং গত অর্থবছরে আমাদের চালের উদপাদন ছিলো প্রায় ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ লাখ টন চালের উদ্বৃত্ত উদপাদন হয়। (তথ্যসুত্র– বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাসকিং মিল ওনার্স এসোসিয়েশন)।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর তথ্য মতে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ২১ কোটি এবং চালের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৪ কোটি ৪৬ লাখ মেট্রিক টন। দেশের ধানের ফলন বর্তমানের মতো অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে বছরে উদপাদন হবে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ টনের কিছু বেশি।
কিন্তু এখন কথা হলো, কৃষকরা যদি তাদের ধানের নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং যৌক্তিক কারণে নওগাঁ এবং উত্তরাঞ্চলের অনন্য জেলার চাষিদের মতো ধান চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ফসল চাষ করতে শুরু করেন এবং ফলন বছর বছর না বেড়ে বগুড়ার মতো কমতে থাকে, তবে ২০৫০ সালে সাড়ে ২১ কোটি জনসংখ্যার জন্য যে পরিমাণ চাল লাগবে তা দেশে উদপাদন করা কোনো ক্রমেই সম্ভব হবে না, যদি না কৃষি প্রযুক্তিতে অভাবনীয় কিছু উন্নতি না হয়। তারপর, আবার প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের কৃষকদের বড় বড় সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়। বড় ধরনের যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের এই হিসাব-নিকাশকেই উল্টিয়ে দিতে পারে।
তার মানে হলো, ২০৫০ সালের আগেই হয়ত আমাদের আবার দেশের বাইরে থেকে বড় অংকের চাল আমদানি করতে হবে। কিন্তু, দেশে সরকার যে দরে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে পারে, বিদেশ থেকে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দরে চাল আমদানি করতে হয়। তবে দেশের কৃষকদের ধানের নায্য মূল্য নিশ্চিত করতে পারলে হয়ত বাংলাদেশের ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ সুনামটা ধরে রাখতে পারবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা বা আতঙ্ক তৈরি হবে না।
তাই পরিশেষে বলা যায়, যে কৃষকের পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো তাদের প্রতি উদাসীনতা দেখালে তো আর সেই স্ট্যাটাসটি থাকবে না।
মোস্তফা সবুজ, দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া সংবাদদাতা
mostafashabujstar@gmail.com
Comments