‘শিক্ষক হওয়ার চাইতে দলের প্রতিনিধি হিসেবেই ভূমিকা স্পষ্ট করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরিন আহমদ, অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল

বহু প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো আজ। সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণের কথা থাকলেও একাধিক হলে বিকেল পর্যন্ত ভোট নিতে হয়েছে। এর মধ্যেই সবগুলো বিরোধী প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট কারচুপির মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে নির্বাচন বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবিতে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে তারা। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে আয়োজিত এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল কিনা- প্রশ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরিন আহমদ, অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন।

উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরিন আহমদ বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে সিল মারা ব্যালট উদ্ধার প্রসঙ্গে বলেন, শুরুতেই যে ঘটনা হলো সেটাকে আমরা কেউই সমর্থন করি না। তবে এটা ঠিক যে সেটা নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই ঘটনাটা প্রকাশ হয় ও কিছু ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা হলো। সুফিয়া কামাল হলের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ভোটার সংখ্যা অনেক হওয়ায় লাইন ধীরে ধীরে এগিয়েছে, অনেক হলেই আমরা এমনটা দেখেছি। ছেলেরা যত দ্রুত ভোট দিতে পেরেছে মেয়েরা সে তুলনায় সময় নিয়েছে বেশি এটাও আমরা লক্ষ্য করলাম।

সামসুন্নাহার হলের ভোটের পরিবেশের কথা বলতে গিয়ে বলেন, সেখানে গণ্ডগোলটা করেছে মিডিয়া। তারা একদম ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লাইভ করতে চাইছিল। কিন্তু আচরণবিধিতেই এটা বলা ছিল যে গণমাধ্যম কতদূর পর্যন্ত ঢুকতে পারবে।

ছাত্রলীগ বাদে প্রায় সব প্রার্থী নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি বড় ছাত্র সংগঠন তো ঠিকমতোই নির্বাচন করল। তারা তো কোনো অনিয়ম করেনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেলের নুরুল হক নুরের ওপর হামলা হয়নি তার পরও তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ভান করেছেন দাবি করে তিনি বলেন, ছোট ছোট এসব ঘটনা দেখেই মনে হয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছিল। যারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই এটা করেছে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পরই সবার মধ্যে একটা শঙ্কা ছিল। উপজেলা, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেটার প্রতিফলনও দেখা গেছে। তার পরেও নির্বাচনের নামে ইসি, আমলা ও পুলিশ ৩০ ডিসেম্বর যে প্রহসন করল, একই ঘটনা যে বিশ্ববিদ্যালয়েও হতে পারে সেটা অনেকেই ভাবতে চায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যেহেতু শিক্ষকরা চালায় ন্যূনতম একটা মান সেখানে থাকবে, এরকম একটা প্রত্যাশা ছিল কারও কারও মধ্যে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষক হওয়ার চাইতে দলের প্রতিনিধি বা ছাত্রলীগের প্রতিনিধি হিসেবেই নিজেদের ভূমিকা স্পষ্ট করেছে।

তিনি বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু ন্যায্য দাবি ছিল। গণরুমের দখলদারিত্ব, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুগত বাহিনী তৈরি ও হলে হলে যে ভয়ের রাজত্ব ছাত্রলীগ তৈরি করে রেখেছে সেটার কারণে হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না সেটা সবাই জানতেন। একারণেই একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি ছিল। এই দাবি না মানার মধ্য দিয়েই প্রশাসন বার্তা দিয়ে দিয়েছিল যে তারা ছাত্রলীগকে জিতিয়ে আনতে চায়। আমার কাছে বরাবরই মনে হয়েছে যে প্রশাসনের লক্ষ্য হচ্ছে সরকারি ছাত্র সংগঠন যে হলে হলে আধিপত্য, নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে কর্তৃত্বের একটা বৈধতা দেওয়া। তাদেরকে বৈধ কর্তৃত্বের যায়গায় বসানো সরকার এবং প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল। এমনটা আগে থেকেই আমার কাছে মনে হয়েছে। আজ দেখলাম সেখান থেকে প্রশাসন একটুও নড়েনি।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেহেতু প্রশাসন চালান সেদিক থেকে এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার ব্যাপার, শিক্ষক হিসেবেও এটা খুব লজ্জার ব্যাপার। শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন বলে একটা অপরাধ বিবেচনা করা হয়। যে শিক্ষকরা ব্যালট বাক্স ভরানো বা বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-কারচুপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের অপরাধ নৈতিক স্খলনের মধ্যেই পড়ে।

অর্থনীতির এই অধ্যাপক আরও বলেন, ভয়ের রাজত্ব তৈরি করাটা সরকার তার সাফল্য হিসেবে দেখতে পারে। এখানে সাধারণ শিক্ষক অনেকেই আছেন যারা ভয়ের কারণে বা মেরুদণ্ডহীনতার কারণে সরকার বা ছাত্রলীগ যা বলে তাই করেন। শিক্ষক হিসেবে তাদের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। আর একটা অংশ আছে যারা ভীত-সন্ত্রস্ত। এটা খুব হতাশাজনক। বর্তমান সময়ে এটাই সবচেয়ে বড় সংকট যে বিদ্যোৎসমাজ বা ইন্টেলেকচুয়ালরা অন্যায়ে সহযোগিতা করছেন বা নীরব থাকছেন। এটা খুব বড় সংকটের জায়গা।

তবে এর মধ্যেও আশার জায়গা দেখছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বললেন, যেভাবে হাতুড়ি বাহিনী, হেলমেট বাহিনী, পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেভাবে ভয়ভীতি ছড়ায় এর মধ্যেও শিক্ষার্থীরা সামনে আসছে, প্রতিবাদ করছে। এটা অনেক বড় আশার জায়গা। আবার এধরনের প্রতিবাদী কিছু শিক্ষকও আছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহ্যের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে এমনটা আমি মনে করছি না।

২৮ বছরের অপেক্ষার পর এই ডাকসু নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, যা হয়েছে তাতে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি, হতাশ হয়েছি কিন্তু অবাক হইনি। একটা দেশের সরকার যখন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়, রাতের ভোটে নির্বাচিত হয় তখন সেই সরকারের পদলেহি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থাকলে তারা সরকারি মডেলটাই অনুসরণ করার চেষ্টা করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য, স্বতন্ত্র চরিত্র, স্বায়ত্তশাসন-- কোনো কিছুই তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। এমনকি তারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেটিও বিবেচ্য না। তারা শুধুমাত্র সরকারের পদলেহি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।

আইন বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ২৯ ডিসেম্বরের রাতের ধারাবাহিকতায় নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের নামে মহাকারচুপির বিষবৃক্ষ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার দুঃখ লাগছে এ কারণে যে, এই নির্বাচন না হলেই ভালো হতো। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না, দেশের সব বিবেকবান মানুষের রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। যে ভোটের অধিকার মেনে নেওয়া হয়নি বলে আমরা দেশকে স্বাধীন করেছিলাম আজকে সেই ভোটের অধিকার নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম কারচুপি করা হচ্ছে।

গণতন্ত্রের নামে পৃথিবীতে যত দেশ আছে তার মধ্যে জঘন্যতম নির্বাচন বাংলাদেশে হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবিক মর্যাদার প্রতি এটা উপর্যুপরি ও নির্মম চপেটাঘাত ছাড়া কিছুই নয়। যা ইচ্ছা তাই করা হবে, কেউ কিছু বলতে পারবে না- যেন এই বার্তাটা দেওয়া হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh garment exports face US tariff hike

Can Bangladesh retain its foothold in US market?

As Bangladesh races against a July 9 deadline to secure a lower tariff regime with the United States, the stakes could not be higher.

15h ago