মমতার ধর্না নিয়ে রাজনৈতিক ‘ময়নাতদন্ত’
মমতার ব্যানার্জির ধর্না প্রত্যাহার হলো মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। কিন্তু এখনও ভারত জুড়ে ধর্না মঞ্চের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ চলছে। তর্ক-বিতর্কের মূল বিষয়, এই ধর্না মঞ্চে মমতার কতটা লাভ হলো, বিজেপির কতটা ক্ষতি হলো। কিংবা উল্টোটাও।
বিজেপির বিরুদ্ধে দেশের সংবিধান বাঁচানোর লড়াইয়ের ডাক দিয়ে রোববার সন্ধ্যা থেকেই কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী মঞ্চ গড়ে ধর্নায় বসেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শুধু এখন এই দুটি পদেই নন বরং বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক জোটেরও অন্যতম মুখ।
এবার ধর্না মঞ্চে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে দেবে গৌড়া, স্ট্যালিন, অখিলেশ যাদবসহ বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রধানরা মমতার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। আর যেভাবে প্রকাশ্যে মমতার পাশে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধী মোর্চার আরেক প্রধান নেতা অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্র বাবু নাইডু মমতাকে এই জোটের কাণ্ডারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, তাতে এই শক্তির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা অন্তত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ভারতের রাজনৈতিক মহলে অবশ্য দুরকম মতামত শোনা যাচ্ছে।
একটি মহল বলছেন, মমতার এই ধর্না আন্দোলনের ফলে সংবিধানের সংকট আরও প্রবল হলো। কেননা কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে সিবিআই-কে তদন্ত করার স্বাধীনতা সংবিধানই দিয়েছে। আর দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশনা মেনেই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। কিন্তু সিবিআই সেই তদন্ত চালাতে পারল না। কে তাদের বাধা দিয়েছে, পুলিশ। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত তারা।
এই যখন অবস্থা তখন আবার মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি ওই পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে চলে গেলেন, তার বাড়ির সামনে থেকেই সাংবাদিকদের জানালেন সংবিধান সংকটে। সেটা বাঁচাতে ধর্নায় বসবেন। তাই করলেনও।
আবার আরেকটি মহল বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই তদন্ত করছে সিবিআই। তবে কলকাতার পুলিশ প্রধান রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশও তো সেই শীর্ষ আদালতই দিয়েছেন। আর রাজীবকে গ্রেপ্তারে সংবিধান সংকটের থাকার অভিযোগ তুলেই তৃণমূল নেত্রী অনশনে বসেছিলেন। তাই সুপ্রিম কোর্টের রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তারের নিষেধাজ্ঞাকে মমতার নৈতিক জয় হিসাবেই দেখছেন।
মমতার এই ধর্নাকে এককথায় কটাক্ষ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তার প্রশ্ন, তিনি চিট-ফান্ডের কোটি কোটি ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং সারা ভারতের মানুষ, গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন কেন? অধীর চৌধুরী মনে করেন, আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেকোনো কিছুর জন্য সিবিআই তদন্ত চেয়ে আন্দোলন করতেন। এমন কি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সেটা করেছিলেন। এতে মমতা মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই এই অনশন গুটিয়ে দিতে হয়েছে কারণ এই আন্দোলনের সঙ্গে মানুষের কোনও সমর্থন নেই।
একইভাবে ধর্নাকে কটাক্ষ করেছেন বাম নেতৃত্বও। সিপিআই'র সাংসদ সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, এর আগে তৃণমূলের কয়েকজন সাংসদ, মন্ত্রীকেও সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে। বছরের পর বছর জেলে রেখেছে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো কখনোই এমন প্রতিবাদী হয়ে উঠেননি। তবে কেন কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে সিবিআইয়ের হানার ঘটনায় তিনি ধর্নায় বসলেন। সুজন চক্রবর্তী বলেন, আসলে পুলিশকে না বাঁচালে তিনি নিজেই ফাঁসবেন। সেটা বুঝেই এমন আন্দোলন মমতার।
মমতার এই আন্দোলনের নিয়ে কলকাতার একজন সিনিয়র সাংবাদিক কৃষ্ণেন্দু কর্মকার মনে করেন, মমতার আন্দোলনের প্রতি শহরের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষের সমর্থন বেশি। শহরকেন্দ্রিক জনপ্রিয়তার চেয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে মমতার এই ধরনের আচমকা কর্মকাণ্ড মানছেন এই সাংবাদিক। তার মতে, লোকসভার ভোটের আগে তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্ককে চাঙা করতে মমতার এটা দারুণ চমক সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মমতা একটা বড় সংকটকে সামনে এনেছেন। আর সেটা হচ্ছে, সিবিআই এবং পুলিশ দুটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে মুখোমুখি করেছেন। এটা দীর্ঘ মেয়াদে খুবই ভয়ঙ্কর হবে ভারতীয় গণতন্ত্রে।
ধর্না নিয়ে বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বও অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই মমতার সমালোচনা করেছেন। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, দিদিমণি কি ভয় পেয়ে গিয়েছেন যে তিনি পুলিশ কমিশনারকে বাঁচাতে এইরকম নাটক করলেন।
কি আছে কমিশনারের বাড়িতে সেটা তো দিদির এই আচরণ থেকে রাজ্যবাসীর শুধু নয় গোটা দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে সাধারণ মানুষের অনেকেই মনে করেন, তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী বিজেপির বিরুদ্ধে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেটা রাজ্যবাসীর জন্য ভালো হবে। কারণ বিজেপি ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছে দেশজুড়ে। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার মতো একমাত্র মমতাই আছেন।
অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, বিহারের আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবও মঙ্গলবার ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে চলা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখ হিসাবে মমতাকে সামনে রাখার কথা বলেছেন। আর মাত্র দুই মাস পরই ভারতের লোকসভা নির্বাচন। ঠিক এর আগে বিজেপির বিরুদ্ধে মমতাকে প্রজেক্ট করে সামনে এগুতে চাইছেন এই নেতৃত্ব।
এখনে বড় প্রশ্নটি সামনে আসছে কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে। বিজেপিবিরোধী জোটে মমতাকে মুখ হিসাবে আনতে রাজি কি না সেটা এখনও পরিষ্কার করেননি কংগ্রেস নেতৃত্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, রাহুল গান্ধীকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস কোনোভাবেই অন্যকে প্রধানমন্ত্রী প্রজেক্ট করে বিরোধী জোটে সামিল হবে না। কারণ ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার রাহুল গান্ধীই। আর সে কারণেই দলের তার বোন প্রিয়াঙ্কাকে আনা হলো। যাতে প্রধানমন্ত্রী হলে দলকে সামলাতে পারেন প্রিয়াঙ্কা। ফলে মমতা ব্যানার্জি বেশি প্রচার পেলে কংগ্রেসের বড় ক্ষতি হবে। তাই ভেতরে ভেতরে কংগ্রেসও কিছুটা দূরত্ব তৈরি করবে মমতার এমন উত্থান দেখে।
তবে শেষ মুহূর্তে মমতা আদৌ এই ধর্না মঞ্চকে ব্যবহার করে সর্বভারতীয় রাজনীতিক হিসাবে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে পারবেন কি না সেটা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে।
Comments