পশ্চিমবঙ্গে আবারও সক্রিয় বাম রাজনীতি
পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতি সক্রিয় হতে শুরু করেছে। চলতি মাসে ৮-৯ জানুয়ারি ভারত বনধ পালন করে অনেকটা সতেজ বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র কিংবা সুজন চক্রবর্তীর মতো বামফ্রন্ট নেতৃত্ব।
আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি বিগ্রেড ময়দানে বামফ্রন্টের রাজনৈতিক সমাবেশ সফল করতে ইতোমধ্যেই রাজ্যজুড়ে বাম সমর্থকরা সক্রিয়ভাবে মাঠে নেমেছেন।
২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিরোধীশক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে কার্যত খড়কুটোর মতো সাফ হয়ে যায় টানা ৩৪ বছরের বাম শাসন। এরপর থেকে প্রায় দৃশ্যহীন হতে দেখা গিয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে বামদের সক্রিয় রাজনৈতিক অবস্থান।
যদিও ফিনিক্স পাখির মতো ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আবারও কিছুটা সক্রিয়ভাবে ভোটের মাঠে নামতে দেখা গিয়েছিলো বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, রবীন দেবের মতো প্রবীণ বাম নেতৃত্বকে। কিন্তু, ভোটের সেবার হেরে গিয়ে আবারও থলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন ওই বাম নেতৃত্বরা।
নেতৃত্বের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভূমিকা না দেখে লাখ লাখ বাম সমর্থক-কর্মীরাও হতাশ হয়ে রাস্তায়, পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে পত্রিকা পড়ছেন; রাজনৈতিক আলোচনার ঢেকুর তুলেছিলেন। এভাবে দীর্ঘ কয়েক বছর তাদের সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে।
তবে সেই পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে বলেই মনে করছেন বাম রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, শাসক তৃণমূল এবং বিরোধী বিজেপি দুটো রাজনৈতিক দল যেভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগকে সামনে এনে রাজনীতি শুরু করেছে; সেখানে এই মুহূর্তে রাজ্যের মানুষের সামনে বাম রাজনীতিটা কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
আর বাম রাজনৈতিক মনে করছেন এখন ঘরে বসে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। বরং রাজ্যবাসীর সামনে দুটি রাজনৈতিক দলের এই বিভাজনের চিত্রটাকে আরও স্পষ্ট করতে ‘বাম কণ্ঠস্বর’ আরও জোরালো করতে হবে।
মূলত এই সূত্রকে সামনে রেখেই আগামী এপ্রিল-মে মাসে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে ফের সক্রিয় হতে শুরু করেছেন বাম নেতৃত্বরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একজন সিপিআইএম নেতা বলেছেন, এটা ঠিক যে বাম সমর্থকরা আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে হতাশ। সেই হতাশা দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যজুড়ে বামদের আবার আগের মতোই সক্রিয় হতে দেখা যাবে- যোগ করেন ওই নেতা।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সাংবাদিক সম্মেলনে দলের শীর্ষ নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সম্প্রতি রাজ্যজুড়ে ৪৮ ঘণ্টা হরতালে সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণে ‘বামফ্রন্ট শক্তি ফিরে পাচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
সূর্যকান্ত বলেছেন, ধর্মঘটের মানুষের যে হারে সাড়া পেয়েছি তা খুবই ইতিবাচক।
আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড ময়দানের বামদের ডাকা সমাবেশকে ‘মোদী বিরোধী সমাবেশ’ কিংবা ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমাবেশ’ হিসেবে দেখা হলেও মূলত গত ৭ বছরে রাজ্যের হাজারো বাম সমর্থক-কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর ‘রাজনৈতিক টনিক’ হিসেবে সমাবেশকে সফল করতে চাইছেন বাম নেতৃত্ব।
হাওড়ায় একটি রাজনৈতিক সভায় দলের নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র আশা করেন যে, বিগ্রেডের সমাবেশে দলীয় কর্মীরা চাঙ্গা হবেন। কর্মীদের অনেক দিনের দাবি ছিলো এই ধরণের সমাবেশ।
সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী জানান, তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই যেমন চলছে তেমন বিজেপি তথা ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধেও লড়াই অব্যাহত রয়েছে। দলের কর্মীরা সবাই এখন আরও সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক মোকাবেলা করতে চাইছেন।
বাম রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিপ্রতীপ দে মনে করেন, সব সময় শাসক দল বাড়তি অক্সিজেন পায় রাষ্ট্রের কাছে। যেমন তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর তারা যেভাবে বিরোধীদের দমন করেছেন; পুলিশ প্রশাসন ব্যবহার করে ভয়ের আবহ তৈরি করেছে রাজ্যজুড়ে; তাতে স্বাভাবিকভাবেই অস্তিত্ব বাঁচাতে বাম সমর্থক-কর্মীরা চুপ ছিলেন।
তবে পরিস্থিতি এখন তেমন নেই। রাজ্যের বিরোধীরা শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। যেহেতু বিজেপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই ধর্ম নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ রয়েছে তাই রাজ্যের অধিকাংশ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তাদের মানতে পারছেন না, সেখানে একটা বিকল্প প্রয়োজন। সেই বিকল্প বামেরাই হতে পারেন।
এটি বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র কিংবা সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রকাশ কারাত, সীতারাম ইয়েচূরিরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন- মন্তব্য বিপ্রতীপ দে’র।
প্রবীর রায় চৌধুরী নামের জেলা পর্যায়ের একজন বাম কর্মী জানান, নেতৃত্বের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আছে কিন্তু প্রবীণ বাম নেতারা নতুনদের রাজনীতিতে সুযোগ দিচ্ছেন না। সে কারণেই তরুণরাও বামফ্রন্টের সামিল হচ্ছেন না। শুধু সরকারি দলের কর্মকাণ্ড নয়, বরং বামদের নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলের পুরনো চিন্তাধারার পরিবর্তন করতে হবে। নতুনদের চিন্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
যদিও নতুন-পুরনো নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র কিংবা রবীন দেবের মতো বর্ষীয়ান বাম নেতৃত্ব।
প্রসঙ্গত, সিপিআইএম, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক সহ চারটি বামপন্থী দল নিয়ে বামফ্রন্ট গঠিত হয়। যদিও তাদের নিজেদের মধ্যেও রাজনৈতিক দূরত্ব রয়েছে।
Comments