বিজেপির পরাজয়ের কারণ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১৬ সালে ভারতে ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল এবং পরবর্তীতে পরপর দুটি বড় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ভারত থেকে পালানোর ঘটনায় বিজেপিবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে।
ভারতের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর দলের ভরাডুবির পেছনে প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। ছবি: রয়টার্স

ভারতের বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে স্থানীয় রাজ্য সরকার নির্বাচিত করেন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মানুষ। রাজ্যের অর্থনীতি, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও নানাবিধ স্থানীয় সমস্যার ওপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক দলগুলো গণরায় আদায়ের চেষ্টা করে। কিন্তু ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের ভোটের ফলাফলের ক্ষেত্রে ভিন্ন উদাহরণ তৈরি হলো। সেটা, বিজেপিবিরোধী মনোভাব। কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে এই মনোভাব প্রবল হয়েছে যার প্রভাব বিধানসভা নির্বাচনে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১৬ সালে ভারতে ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল এবং পরবর্তীতে পরপর দুটি বড় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ভারত থেকে পালানোর ঘটনায় তিন রাজ্যেই বিজেপিবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে।

বিজেপির বিরুদ্ধে যতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নষ্টের অভিযোগ থাকুক, গো-রক্ষার নামের মানুষ হত্যার অভিযোগ আসুক; মূল বিরোধিতার সুর চাড়ার কারণ একটাই। সেটা হলো মোদির প্রতিশ্রুত উন্নয়নের ‘আচ্ছে দিন’ বা সুদিন আনতে না পারা এবং এরপরও অতিচালাকি করে যাওয়া।

ভারতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশই মনে করে, ডিমনিটাইজেশন বা নোট বাতিলের ফলে ২০১৬ সালের পর থেকে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। জনগণের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছে ক্রমশ। এরপর একের পর এক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। কালো টাকা উদ্ধার তো দূরে থাক, বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ওই নীরব মোদি, মহুল চকসির মতো লুটেরাদের পালাবার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার অভিযোগও ভোটাররা বিবেচনায় নিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাধারণ মানুষের মুখে যতটা না বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির অভিযোগ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি শোনা যায়, অর্থনীতির দুরবস্থায় ঘরে ঘরে টানাপড়েন। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের পকেট কেটে নিচ্ছে জিএসটি নামের একটি কর আদায় ব্যবস্থা।

মধ্যপ্রদেশে তিন বারের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া প্রবল ছিলই। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে বিরোধী কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাদের মুল প্রচারণা ছিল বিজেপির প্রচারের উল্টোটা।

কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করার আগে দেশজুড়ে মানুষের জন্য বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ‘আচ্ছে দিন আয়েগা’ অর্থ্যাৎ ভারতের মানুষকে সমৃদ্ধিশালী একটি দেশ উপহার দেবেন নরেন্দ্র মোদি।

গত সাড়ে চার বছরের মোদি কি সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পেরেছেন, কিংবা অর্ধেকও। সেটাই ছিল বিজেপি বিরোধী কংগ্রেস শিবিরের মূল প্রচারের অস্ত্র।

ভোটের প্রচার প্রচারণা বিশ্লেষণ করে এমন কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়।

পাঁচ রাজ্যের তিনটি ছত্তিশগড়, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ যথাক্রমে দুবার, দুবার এবং তিনবারের বিজেপি সরকার ছিল। রাজ্য গুলোতে বিজেপির পক্ষে প্রচার প্রচারণার কমতি ছিল না।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহও প্রচার প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। পক্ষান্তরে রাহুল গান্ধী পাঁচ রাজ্যে ২৭ দিনে ৬৭টি জনসভায় অংশ নেন। এবার প্রচারণায় মোদি যেমন সুদিন আনার কথা বলেছেন, তেমন পাল্টা রাহুল গান্ধী হাজার কোটি টাকা নিয়ে নীরব মোদির দেশ থেকে পালানো, নোট বাতিলে অর্থনীতি ভেঙে যাওয়ার কথা বলেছেন।

প্রচারণায় যদিও রাহুলের চেয়েও পিছিয়ে ছিলেন মোদি। তিনি পাঁচ রাজ্যের ভোটের প্রচারের সময় দিয়েছেন মাত্র ১৮ দিন। আর সভা করেছেন ৩১টি।

শুধু তাই নয়, মোদি বনাম রাহুল গান্ধীর মধ্যে এই জনসভার পাল্টাপাল্টি মন্তব্যগুলো যদি বিশ্লেষণ করা যায় তবে এটা পরিষ্কার কংগ্রেস মোদির বিরুদ্ধে হাতির করেছে দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা এবং মোদির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ।

যেমন মোদি রাহুলকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ইনি কংগ্রেসের কোনও বিধবা যার অ্যাকাউন্টে টাকা যেত?

পাল্টা রাহুল গান্ধীর উত্তর ছিল, সোজা কথা, নরেন্দ্র মোদি মদতে আপনাদের টাকা আপনাদের কাছ থেকে চুরি করা হয়েছে।

নোটবন্দী নিয়ে গান্ধী পরিবারকে খোঁচা দিয়ে মোদি বলেছিলেন, নোটবন্দীর জন্য দেশের শুধুমাত্র একটি পরিবারই কেঁদে চলেছে, তাদের মুখেই শোনা যাচ্ছে নোটবন্দী নোটবন্দী আর নোটবন্দী...।

পাল্টা রাহুল গান্ধীর বক্তব্য ছিল, ভারতের একটি সত্যিকারের সরকার প্রয়োজন, যারা মিথ্যা প্রচার করে না।

কৃষকদের উদ্দেশ্য করে নির্বাচনী প্রচারে মোদি ভোট দেওয়ার আহবান করে বলেছিলেন, টিভিতে দেখায়, দুধ খেয়েছ? খেয়ে নাও। মঙ্গল হবে। আপনারা একবার সঠিক বোতামে চাপ দিন, দেখবেন মঙ্গল হয়ে গেছে। পাল্টা প্রচারে রাহুল বলেছিলেন, মোদি আসলে দুটো ভারত তৈরি করেছে। একটি আম্বানিদের অন্যটি কৃষকদের।

অর্থনীতি নিয়ে মোদির ভাষণ ছিল, ওদের বন্ধুরা বিছানা, গমের নীচে টাকা লুকিয়ে রাখতো। এখন ভাবে, এই মোদি কী বস্তু- নোটবন্দী করে সব বের করে নিল। পাল্টা রাহুল গান্ধীর উত্তর, ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তো, নীবর মোদী, মেহুল চোকসিদের দেখলেন সেখানে…।

মোদি-রাহুল গান্ধীর পাল্টাপাল্টি এমন মন্তব্য থেকেও পরিষ্কার মোদির বিরুদ্ধে ওই তিন রাজ্যের মানুষ অর্থনীতির উন্নয়ন না করে বড় কথা বলাকে ভালো চোখে দেখেননি।

আর এই পাঁচ রাজ্যের প্রায় সবগুলোই কৃষিপ্রধান রাজ্য। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, কৃষি ঋণ দেওয়া এবং মওকুফ করা নিয়ে কেন্দ্রের নীতি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কেন্দ্রের নীতির বিরুদ্ধে রায় হিসাবে তিন রাজ্যে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের বিজেপির রাজ্য সরকার পড়েছে। অন্যদিকে তেলেঙ্গানায় টিআরএস বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোয় এবং রাজ্যের অর্থনীতির বিকাশে বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় নিজেদের পক্ষে জনরায় পেয়েছে। অন্যদিকে মিজোরামের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রায় যাওয়ার কারণ সেখানে রাজ্য সরকার স্থানীয় উন্নয়নে তেমন ভূমিকা নিতে পারছিল না।

পাঁচ-রাজ্যের সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা রাজ্য ছত্তিশগড়। রাজ্যটির শাসক ছিল বিজেপিই। কেন্দ্রের নীতি রাজ্যও বাস্তবায়ন করেনি সেখানে।

রাজস্থানে ক্ষেত্রে কিছুটা রাজপরিবারের অতি দম্ভকে দায়ী করা যেতে পারে। বিশেষ করে রাজরানী অর্থাৎ বিজেপি নেত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিরায়র বিরুদ্ধে জনরোশ ক্রমেই বাড়ছিল। সেটায়  যোগ হয়েছে কেন্দ্রের অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে জনগণের অবস্থান।

মধ্যপ্রদেশের কৃষক অসন্তোষ গোটা ভারতে বেশ কিছু দিন ধরেই আলোচনায় ছিল। বহু কৃষক আত্মহত্যা করেছে সেখানে। এই ঘটনায় বিজেপির রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের সরকারও সমালোচনার মুখে পড়ে। এরই প্রভাব পড়েছে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে।

Comments

The Daily Star  | English

Four US senators write to Yunus urging reforms and accountability

The senators also called for stronger law enforcement and swift action to hold accountable those responsible for attacks on vulnerable communities, including the Hindu population and Rohingya refugees in Cox's Bazar

54m ago