ভারতে ইভিএম অভিজ্ঞতা ও বিতর্ক
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিজেপি ছাড়া আর কোনো দলই ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। অনেক দল আবার সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বিভ্রান্তও।
রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে ইভিএমের ভোট বড় উদাহরণ।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে ভারতের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে এতো ক্ষমতা দিয়েছ যে এখানে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও কঠিন।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ১৯৯৯ সাল থেকে ইভিএম যুক্ত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে।
তবে এই ব্যবস্থায় ভোটে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছুটা বিরোধিতা থাকলেও নির্বাচিত সরকার নিয়ে বড়সড় কোনও প্রশ্ন তোলেনি কোনো দলই। আর সংবিধানের বলে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ভারতের নির্বাচন কমিশন। তাই সেই কমিশন নিয়েও দলগুলোর অভিযোগ খুব দৃঢ় হয়নি কখনো।
যদিও দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে ব্যালট বাক্সে ফিরে আসার দাবি তুলতে শুরু করেছে। উদাহরণ দিয়ে তারা বলছে, ইউরোপের জার্মানিসহ বড় সব দেশ ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ফিরে এসেছে। আমেরিকার প্রযুক্তিবিদরা ইভিএমের ত্রুটিগুলো সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করেছে। আমেরিকার গণতন্ত্রের স্বার্থে ব্যালটে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। উন্নত দেশগুলো যদি ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ফেরে, তবে ভারতকে কেন ইভিএমে থাকতেই হবে?
ভারতের নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে কয়েক দফায় ইভিএম প্রযুক্তির সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ ইভিএমের সঙ্গে ভেরিফিকেশন স্লিপ বা ‘ভি-এস’ প্রযুক্তিও সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ভোটাররা ভোট দেওয়ার পর একটি প্রিন্টেড স্লিপ পাবেন। অনেকটা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে দোকানে কেনাকাটা করার পর যে-রকম স্লিপ পেয়ে থাকেন গ্রাহকরা, তেমনই।
মানে, এখন থেকে ভারতের ভোটাররা কাকে ভোট দিচ্ছেন সেটার একটা দালিলিক প্রমাণও ভোট দেওয়ার সঙ্গে পেয়ে যাবেন। পরবর্তীতে কোনও সংশয় হলে সেটা নিয়ে তারা মামলা লড়তে পারবেন।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
কিন্তু এরপরও ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ইভিএম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে।
এই দলগুলো মনে করে, ইভিএমে প্রযুক্তির ব্যবহার করে ভোট নয়ছয় করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
যদিও দেশটির নির্বাচন কমিশন বলছে, শুধু আশঙ্কা প্রকাশ করলেই হবে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের পছন্দমত প্রযুক্তিবিদ নিয়ে ইভিএম হ্যাক করে প্রমাণও করতে হবে। আর সেটা করতে পারলে, ইভিএম প্রযুক্তি থেকে সরে দাঁড়াবে কমিশন। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন এই ধরনের একটি বিজ্ঞপ্তিও গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে।
কিন্তু সেখানে সেই চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের যুক্তি দাঁড় করতে পারেনি। নির্দিষ্ট দিনে দু-একজন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নির্বাচন কমিশন দফতরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও প্রমাণ কিংবা পাল্টা যুক্তি তুলে ধরতে পারেননি।
তবে এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ও নীতি নির্ধারকদের একজন সুখেন্দু শেখর রায়।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ভারতবর্ষে একটা সাইবার অ্যাক্ট আছে। কেউ যদি সরকারি কোনও তথ্য কিংবা প্রযুক্তির ব্যবহারে কিছু হ্যাক করে তবে সেই তথ্য প্রযুক্তি আইনের তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। নির্বাচন কমিশনের সেই দাবি মেনে রাজনৈতিক দলগুলো যদি এমন করতো তবে সাইবার অ্যাক্টে তাদের ফাঁসিয়ে দেওয়া হতো। সে কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো হ্যাক করার চেষ্টাই করেনি।
আর ইভিএম নিয়ে সংশয় ও অবিশ্বাসের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের উপনির্বাচনে ইভিএমের ফলাফল থেকে আমাদের মনে সন্দেহ দানাবাঁধে। যারাই ভোট দিয়েছেন সেখানে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঘরেই সব ভোট পড়েছে। এতে জড়িত থাকায় ৬ জন নির্বাচন কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে কমিশন।
এই যখন ঘটনা; তখন আগুনে ঘি দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন প্রযুক্তিবিদ। তারা দাবি করেছেন যে ইভিএম মেশিন হ্যাক করা সম্ভব- যোগ করেন সুখেন্দু শেখর রায়।
তৃণমূলের সঙ্গে সুর মিলে গিয়েছে বামদেরও। বামপন্থী নেতা সুজন চক্রবর্তী তাদের দলীয় অবস্থান নিয়ে বলতে গিয়ে জানান, ইভিএম ভোটের ফলাফল দ্রুত প্রকাশ করাতে সাহায্য করে এটা যেমন ইতিবাচক একটি দিক তেমনই এটা যেহেতু একটা প্রযুক্তিতে চলে, সফটওয়ার এটাকে চালায় সেখানেও হ্যাক করার সুযোগ আছে। যদিও ভি-স্লিপ করা হচ্ছে এবার থেকে। কিন্তু সেটাও কতটুকু কার্যকর হবে প্রয়োগ না করা পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি বারকোড দেওয়া ব্যালটে ভোট হতে পারে। তবে ভারতেরও সেটা সম্ভব নয় কেন। নিশ্চয় নির্বাচন কমিশন এসব নিয়ে ভাবছে।
বাম-তৃণমূলের আশঙ্কা অমূলক নয়, ইভিএম মেশিনে ইচ্ছে করলে কারচুপি করা যেতে পারে এমন দাবি কংগ্রেসেরও। দলটির শীর্ষ নেতা ও প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য দ্য ডেইলি স্টারকে বললেন, ‘আচ্ছা কোনো সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার কি অস্বীকার করেছেন এটা ম্যানুপুলেটেড হয় না?
আমরা মনে করি ইভিএম মেশিনকে অনেক সময় অনায়াসেই ম্যানিপুলেশন করা যায়।
বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতারও যুক্তি; ‘ইউরোপ-আমেরিকায় তো তারা ব্যালটে ফিরে গিয়েছেন। তো ভারতেও সেই ধরনের একটা আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে।’
তবে কেন্দ্রের শাসক দল অর্থাৎ ভারতীয় জনতা পার্টি- বিজেপি অন্য বিরোধীদের সঙ্গে একমত নয়। দলটি মনে করে, ইভিএমকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক ও আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। আর সে কারণে এবার থেকে ইভিএমের ভোটদাতারা প্রত্যেকেই একটি করে ভোটিং স্লিপ পেয়ে যাবেন। তাতে তিনি কাকে ভোট দিলেন সেটা লেখা থাকবে। এটা থেকেই প্রমাণ হচ্ছে ইভিএম এখন কতটা প্রাসঙ্গিক- দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন নির্বাচনী কর্মকর্তা মীরা পাণ্ডে গণমাধ্যমকে সম্প্রতি বলেছেন, প্রযুক্তিবিদ নন বলে প্রযুক্তির বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য নেই। তবে নির্বাচন ব্যবস্থায় ইভিএম একটা আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
ভারতের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কিন্তু রাজনৈতিক দলের এই অভিযোগকে অস্বীকার করতে না পারলেও নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ না নেওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগের দুর্বলতাকেই চিহ্নিত করছেন অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। প্রায় দুই দশক ভারতের সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসাবেই সমাদৃত পেশায় শিক্ষক এই ব্যক্তি।
দ্য ডেইলি স্টারকে এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, আসলে মূল বিষয়টি হচ্ছে ইভিএম মেশিন যারা তৈরি করছেন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড নামের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এই মেশিন তৈরি করছে। এখনও পর্যন্ত মেশিন নিয়ে অভিযোগ তুললে রাজনৈতিক দলগুলো সেই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। ফলে অভিযোগ শুধু তুললেই হবে না সেটাকে প্রমাণ করতে হবে।
অভিযোগ কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়। কিন্তু ভোটটা একটা নিরপেক্ষতার বিষয়। তাই এক্ষেত্রে ভারতের সংবিধানের বলে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন কিন্তু সেটা সঠিকভাবে করার চেষ্টা করে বরাবর।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগটাও কমিশন গুরুত্বে দিয়ে দেখছে নইলে তাদের সঙ্গে এই ইস্যুতে কমিশন কথা বলতো না।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকট্রনিক্স ইন্ড্রাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন বা ওয়েবেল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার শাসমল টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ যেমন আছে তেমনই নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রযুক্তির নিয়ে আত্মবিশ্বাসও আছে।
অভিযোগ থাকা আর প্রমাণ করো দুটো এক জিনিষ নয়; ভারতীয় ইভিএম যে প্রযুক্তিতে তৈরি সেটা হ্যাক করা অসম্ভব। আর ইভিএমে ভোট এবং ভোট পরবর্তী ফলাফল প্রকাশ কতটুকু সুবিধাজনক সেটা ইতিমধ্যেই ভারতবাসীর বুঝে গিয়েছেন।
তবে তিনি বলেছেন, প্রযুক্তিটা অবশ্যই আধুনিক হতে হবে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উৎকর্ষও করে চলেছে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ নেই বললেই চল। তাদের কার্যকারিতা, সক্ষমতা ও সৎসাহস নিয়েও প্রশ্ন নেই। এমন একটি নির্বাচন কমিশনকেও ইভিএম নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে।
Comments