আল জাজিরার প্রতিবেদন

ট্রাম্প-মোদি বৈঠকে উঠে এলো যেসব বিষয়

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নেওয়ার পর বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস সফর করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

ট্রাম্প ও মোদির সম্পর্ককে অনেক গণমাধ্যম 'ব্রোম্যান্স' বলে আখ্যায়িত করে থাকে। গতকালকের বৈঠকেও সেই উষ্ণতা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দুই নেতা পরস্পরের উদ্দেশে অনেক প্রশংসাসূচক কথা বলেছেন। তবে বিতর্কিত বিষয়গুলো তারা এড়িয়ে গেছেন।

এসব বিতর্কিত বিষয়ের মধ্যে আছে ট্রাম্পের ঘোষিত 'পারস্পরিক শুল্কনীতি', যার মাধ্যমে তিনি মার্কিন পণ্যের ওপর অন্যান্য দেশ যে হারে শুল্ক আরোপ করে, ঠিক সেই হারেই সেসব দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক বসানোর পরিকল্পনা করছেন।

ভারতের উচ্চ শুল্কহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা করে আসছেন ট্রাম্প, এমনকি মোদিকে বেশ কয়েকবার 'শুল্কের রাজা' বলেও অভিহিত করেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দুই নেতা পারস্পরিক সহযোগিতার একটি 'ফ্রেমওয়ার্ক' তৈরির ঘোষণা দেন।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে চলমান বাণিজ্য বৈষম্য দূর করতে আলোচনায় বসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং আমি একমত হয়েছি।' 

ট্রাম্প-মোদি বৈঠকের চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো—

ট্রাম্পের 'মাগা' আন্দোলনের প্রতি মোদির সমর্থন

এই ডানপন্থীর নেতার বিরুদ্ধেই নিজ দেশে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের অভিযোগ রয়েছে। গতবছর দুই নেতাই পুননির্বাচিত হয়েছেন—মোদি জুনে এবং ট্রাম্প নভেম্বরে। 

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সৌজন্য বিনিময়ের সময় ট্রাম্পের 'মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন' (সংক্ষেপে মাগা) স্লোগানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এর একটি ভারতীয় সংস্করণ উপস্থাপন করেন মোদি।

মোদি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের "মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন'' বা মাগা স্লোগানের সঙ্গে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এটি ধার নিয়ে উন্নত ভারত গড়তে আমরা বেছে নিয়েছি "মেক ইন্ডিয়া গ্রেট অ্যাগেইন" বা মিগা।' 

'যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একসঙ্গে কাজ করে, তখন মাগা ও মিগা এক করে ''মেগা'' হয়ে যায়। এটি একটি মেগা অংশীদারত্ব, যা (দুই দেশকে) সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে,' বলেন মোদি। 

বিজেপির নীতিকেও ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' এজেন্ডার সঙ্গে তুলনা করেন মোদি। তার দাবি, তিনিও নিজ দেশের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন।

বাণিজ্য চুক্তিতে ভারতের ছাড়

ট্রাম্পের শুল্কের মুখে দেশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে, এই আশঙ্কায় বিশ্বনেতাদের অনেকেই ট্রাম্পের দাবি মেনে নিচ্ছে বা বিভিন্ন খাতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার মোদিও এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন।

বর্তমানে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতির জন্য ভারতের আরোপ করা শুল্ককে দায়ী করেছেন ট্রাম্প। 

বৃহস্পতিবার ট্রাম্প বলেন, 'সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতের অন্যায্য, কঠোর শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এসব শুল্ক ভারতের বাজারে মার্কিন পণ্য প্রবেশ বেশ কঠিন করে তুলেছে। এটি সত্যিই একটি বড় সমস্যা।' 

বৈঠকের পর এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে একটি চুক্তির ঘোষণা দেন দুই নেতা। এই চুক্তির মধ্যে মহাকাশ ভ্রমণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং জ্বালানি উৎপাদনে অংশীদারত্বের বিষয়গুলো থাকবে। 

মোদি বলেন, 'আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণেরও চেয়েও বাড়িয়ে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।' 

ট্রাম্প আরও জানান, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি পণ্য আমদানি বাড়াবে ভারত। 

'প্রধানমন্ত্রী এবং আমি জ্বালানি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে সম্মত হয়েছি, যা যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ভারতের শীর্ষ তেল-গ্যাস সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে,' বলেন ট্রাম্প।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মতো মিত্রদের সংযুক্ত করবে এমন একটি আন্তর্জাতিক অবকাঠামো প্রকল্পেরও ইঙ্গিত দেন ট্রাম্প।

'আমরা একসঙ্গে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য পথগুলোর একটি গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছি। এটি ভারত থেকে ইসরায়েল, ইতালি হয়ে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত আসবে। এই প্রকল্পের অধীনে আমাদের অংশীদারদের বন্দর, রেলপথ এবং সমুদ্রের নিচে ক্যাবল দিয়ে সংযুক্ত করবে,' যোগ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

আল জাজিরা জানায়, প্রস্তাবিত ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ ইকোনমিক করিডোরকে ইঙ্গিত করছিলেন ট্রাম্প, যার ঘোষণা প্রথম আসে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে পরিকল্পিত এই করিডোর সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইসরায়েল এবং গ্রিসের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা। তবে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের কারণে এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

'সন্ত্রাসবাদের' বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ওপর জোর

যদিও চীনের আন্তর্জাতিক প্রভাব মোকাবিলাই ছিল বৈঠকের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়, তবে আরেকটি নিরাপত্তা ইস্যু এই দুই  নেতার আলোচনায় উঠে এসেছে—তা হচ্ছে 'সন্ত্রাসবাদের' আতঙ্ক।

মুম্বাই হামলায় অভিযুক্ত শিকাগোর ব্যবসায়ী তাহাওয়ার রানাকে ভারতে প্রত্যর্পণের অনুমোদন দেন ট্রাম্প। ডেনমার্কের একটি সংবাদ সংস্থার ওপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহায়তা করার অভিযোগে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আদালত ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয় রানাকে।

২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও রানাকে এখনো দোষী সাব্যস্ত করেনি আদালত।

রানা ভারতে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। তবে গত মাসে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট তার প্রত্যর্পণ বন্ধের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। বৃহস্পতিবার ট্রাম্পের অনুমোদনের পর এখন এটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল। 

বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন মোদি। জানান, রানার বিরুদ্ধে ভারতের আদালত 'উপযুক্ত ব্যবস্থা' নেবে। 

'ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করবে,' বলেন মোদি।

ট্রাম্প জানান, ভারতের কাছে 'বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের' সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করবে।

'এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও শক্তভাবে উগ্র ইসলামি সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলা করতে একসঙ্গে কাজ করবে। এর প্রভাব বিশ্বজুড়েই রয়েছে,' যোগ করেন ট্রাম্প।

তবে মোদির বিরুদ্ধে মুসলিম-বিরোধী সহিংসতার প্রতি উদাসীন থাকার এবং মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে প্রশ্নের মুখে ট্রাম্প

সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক না, বারবার ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে ট্রাম্পকে।

বৃহস্পতিবার সকালেই ট্রাম্প জানান, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার 'দীর্ঘ ও বেশ ফলপ্রসূ' একটি ফোনালাপ হয়েছে। এরপর তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছেন বলে জানান। 

সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, 'রাশিয়া (ইউক্রেনের) অনেক বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে। এবং তারা প্রথম দিন থেকেই বলে আসছে—শুধু প্রেসিডেন্ট পুতিন না, বহু বছর আগে থেকেই—যে তারা ইউক্রেনকে ন্যাটোর অংশ হতে দেবে না। এটি তারা বেশ জোরালোভাবেই বলেছে। আমি বিশ্বাস করি, এজন্যই যুদ্ধটা শুরু হয়েছে।' 

মোদি এই আলোচনায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ কোনো মন্তব্য করেননি। তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক অবস্থান ভারতকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের শক্তিশালী সম্পর্ক আছে এবং বাইডেন প্রশাসনের সময় রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করার জন্য ভারতকে চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল।

Comments

The Daily Star  | English

A budget without illusions

No soaring GDP promises. No obsession with mega projects. No grand applause in parliament. This year, it’s just the finance adviser and his unemotional speech to be broadcast in the quiet hum of state television.

7h ago