ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন

পালটা হামলার শুরুতেই হোঁচট খেল ইউক্রেন?

সামরিক ক্যাম্পে মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
সামরিক ক্যাম্পে মহড়ায় অংশ নিচ্ছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া, ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর পেরিয়ে গেছে প্রায় দেড় বছর। এ দীর্ঘ যুদ্ধের বেশিরভাগ সময়জুড়ে ইউক্রেন রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়েছে। পশ্চিমা মিত্রদের দেওয়া অস্ত্র ও সরঞ্জাম তাদের প্রতিরক্ষাকে আরও বলিষ্ঠ করেছে।

তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পালটা আক্রমণ চালিয়ে রুশ অধিকৃত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড নিজেদের দখলে ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকারের কথা বলছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এ ধরনের অভিযান পরিচালনার জন্য মিত্রদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক ট্যাংক, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধ বিমান সহ অন্যান্য অস্ত্রও পেয়েছেন তিনি।

পালটা হামলা শুরু?

গতকাল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানা গেছে, ইউক্রেন রাশিয়ার দখলে থাকা দনেৎস্ক অঞ্চলের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ অংশে হামলা চালিয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষকদের মতে, এর মাধ্যমেই ইউক্রেনের তথাকথিত পালটা আক্রমণ শুরু হয়েছে।

তবে 'ব্যর্থ' এ হামলার বিষয়ে কিয়েভ কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ রয়েছে। রাশিয়া জানিয়েছে, এই হামলা প্রতিহত করা হয়েছে এবং ইউক্রেন পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে।

আজ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে বেশ কিছু জায়গায় ইউক্রেনের বাহিনীর এগিয়ে যাওয়ার সংবাদে সেনাদের প্রশংসা করেছেন। এতে পালটা হামলার শুরুর গুজব আরও চাঙ্গা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে অভিযানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অর্থ বহুল প্রতীক্ষিত সেই পালটা হামলা শুরু হয়েছে।

সোমবারের সান্ধ্যকালীন বক্তব্যে জেলেনস্কি রুশদের উপহাস করে বলেন, 'ইউক্রেনের বাহিনী যেকোনো অভিযান চালালেই রুশরা হাস্যকর প্রতিক্রিয়া দেখায়।'

তিনি তার সান্ধ্যকালীন বক্তব্যে বলেন, 'শত্রুরা জানে ইউক্রেন জিতবে। তারা এটা দেখতে পাচ্ছে। আপনাদের হামলা ও সেনাবাহিনীর অভিযানকে ধন্যবাদ, তারা এটা অনুভব করছে—বিশেষত, দনেৎস্ক অঞ্চলে। সে জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।'

ইউক্রেনের স্থলবাহিনীর কমান্ডার ওলেকসান্দার সিরস্কি সোমবার জানান, তার বাহিনী বাখমুতের কাছে 'এগিয়ে যাচ্ছে।' রুশ যোদ্ধা ও কর্মকর্তারা জানান, সেখানে পরিস্থিতি 'খুবই জটিল।' তবে গত মাসে মস্কো বাখমুতের পূর্ণ দখল নেওয়ার দাবি করেছে।

ইউক্রেনের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্না মালিয়ার জানান, কোনো কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন '(প্রতিরক্ষার বদলে) আক্রমণের দিকে ঝুঁকছে।' তবে তিনি একে বড় কোনো পালটা হামলা অভিযানের তকমা দিতে রাজি হননি।

অপরদিকে এসব দাবি অস্বীকার করেছে রাশিয়া। রুশ সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা রোববার থেকে শুরু করে ২টি বড় আকারের ইউক্রেনীয় অভিযান ঠেকিয়েছে। তাদের মতে, ইউক্রেনের পালটা হামলা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় টেলিগ্রামে প্রকাশিত বিবৃতিতে জানায়, '৪ জুন সকালে শত্রুপক্ষ দক্ষিণ দনেৎস্কের উদ্দেশে ৫টি সেক্টরে বড় ধরনের হামলা শুরু করে।'

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'শত্রুর লক্ষ্য ছিল আমাদের সবচেয়ে দুর্বল অংশে আঘাত হেনে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এ জন্য তারা সামনের দিকের সেক্টরগুলো বেছে নেয়। তবে শত্রু তাদের লক্ষ্য পূরণে কোনো সাফল্য পায়নি।'

জার্মান ট্যাংক ধ্বংস ও ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব

জার্মানিতে নির্মিত লেপার্ড-২ ট্যাংক যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে ভাবছে কিয়েভ। ছবি: রয়টার্স
জার্মানিতে নির্মিত লেপার্ড-২ ট্যাংক যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে ভাবছে কিয়েভ। ছবি: রয়টার্স

মঙ্গলবার রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ মাধ্যম আরটি রুশ সামরিক মুখপাত্রের বরাত দিয়ে জানায়, দনেৎস্ক অঞ্চলে এ যাবত ইউক্রেন ১ হাজার ৫০০ সেনা নিহত হয়েছে এবং ৮টি জার্মানিতে নির্মিত লেপার্ড ট্যাংকসহ ২৮টি ট্যাংক, ৩টি ফরাসি এএমএক্স-১০ চাকাযুক্ত ট্যাংক ও আরও ১০৯টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে।

মন্ত্রণালয় আরও জানায়, গত কয়েকদিনের যুদ্ধে কিয়েভ ২৫০ সেনা, ১৬ ট্যাংক, ৩টি আইএফভি ও ২১টি সাঁজোয়া যান হারিয়েছে।

বাখমুত পরিস্থিতি

স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা বাখমুতের যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি। ছবি: রয়টার্স
স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা বাখমুতের যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি। ছবি: রয়টার্স

তবে কিছু ক্রেমলিনপন্থী সামরিক ব্লগার জানান, কিয়েভের বাহিনী কিছু জায়গায় সুবিধা আদায় করে নিতে পেরেছে। রাশিয়ার ভাড়াটে সেনার দল ভাগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন সোমবার জানান, ইউক্রেনীয় সেনারা বাখমুতে কিছুটা এগিয়ে আছেন।

তিনি দাবি করেন, রুশ সেনারা বাখমুতের কাছাকাছি অবস্থিত বারখিভকা গ্রাম ছেড়ে 'ধীরে ধীরে' চলে যাচ্ছেন, যা 'অপমানজনক।'

ভাগনার প্রধান রুশ সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করার আহ্বান জানান।

পালটা হামলা বিষয়ে কিয়েভের অবস্থান

এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। ফাইল ছবি: রয়টার্স
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। ফাইল ছবি: রয়টার্স

কিয়েভ পালটা হামলা শুরু হয়েছে কী না, বা শুরু না হয়ে থাকলে কবে শুরু হবে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি।

গত সপ্তাহান্তে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী একটি প্রচারণামূলক ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায় পুরোপুরি সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত সেনারা ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

এরপর স্ক্রিনে একটা কথা ফুটে ওঠে, 'পরিকল্পনা সফল হওয়ার পূর্বশর্ত নীরবতা। (পালটা হামলার শুরুর বিষয়ে) কোনো ঘোষণা আসবে না।' এরপর কিছু যুদ্ধবিমানকে উড়ে যেতে দেখা যায়।

রাশিয়ার দুর্বলতা খুঁজছে কিয়েভ

বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

আল জাজিরার বিশ্লেষক চার্লস স্ট্র্যাটফোর্ডের মতে, আগামী কয়েক দিনে বোঝা যাবে, ইউক্রেনের এ হামলাগুলো বড় আকারের অভিযানের আগে প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য হামলা না কী ইতোমধ্যে পালটা হামলা শুরু হয়ে গেছে।

ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) জানিয়েছে, তারা ফ্রন্টলাইনে থাকা রুশ ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়েছে, পালটা হামলা শুরু হয়েছে।

'ইউক্রেন কিছু এলাকা দখল করেছে, কিন্তু রাশিয়া তা স্বীকার করছে না', যোগ করে আইএসডব্লিউ।

সামরিক বিশ্লেষকরা আরও জানান, ইউক্রেন তাদের প্রকৃতি যুদ্ধকৌশল লুকিয়ে রাখতে বেশ কিছু জায়গায় একইসঙ্গে হামলা চালিয়েছে, যাতে রাশিয়া তাদের সামরিক উপকরণ ও সম্পদ বিভিন্ন এলাকায় বণ্টন করতে বাধ্য হয়।

ইউক্রেনীয় সামরিক বিশ্লেষক রোমান সিতান বলেন, 'কিয়েভ রাশিয়ার দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।'

দক্ষিণ ইউক্রেনের বাঁধ ধ্বংস

দক্ষিণ ইউক্রেনে নিপ্রো নদীর ওপর অবস্থিত কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
দক্ষিণ ইউক্রেনে নিপ্রো নদীর ওপর অবস্থিত কাখোভকা বাঁধ ধ্বংস হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

আজ মঙ্গলবার রুশ অধিকৃত দক্ষিণ ইউক্রেনে একটি সোভিয়েত আমলের বাঁধ ধ্বংস হয়েছে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্র বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই একে অপরকে এই বাঁধ ধ্বংসের জন্য দায়ী করেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিওতে দেখা গেছে কাখোভকা বাঁধের আশেপাশে বড় আকারে বিস্ফোরণ ঘটেছে। অন্যান্য ভিডিওতে বাঁধের ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে পানি বয়ে যেতে দেখা গেছে।

এই বাঁধের মাধ্যমে রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রিমিয়া ও ঝাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পানি সরবরাহ করা হয়।

তবে এই বাঁধ ধ্বংসে চলমান যুদ্ধে বা ইউক্রেনের পালটা আক্রমণে কী প্রভাব পড়বে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

বিশ্লেষকদের মতে, এই বাঁধ ধ্বংস হওয়ায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউক্রেনে আরও একটি মানবিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। নিজেদের ভূখণ্ড ফিরে পেতে ইউক্রেন যখন পালটা হামলার প্রস্তুতিতে নিচ্ছে, তখনই এই বাঁধ ধ্বংস হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ধরনের রূপান্তর এলো।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা টেলিগ্রামে জানায়, রুশ বাহিনী 'ভীত হয়ে' বাঁধটি ধ্বংস করেছে। তারা আরও বলেন, এটি নিঃসন্দেহে 'সন্ত্রাসী কাজ ও যুদ্ধাপরাধ'। এসব ঘটনাকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে তথ্য-প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।'

আপাতত বাঁধ ধ্বংসে ইউক্রেনের কোনো কৌশলগত সুবিধা আছে বলে ভাবছেন না বিশ্লেষকরা। বরং এতে ক্রিমিয়ায় বহুল প্রতীক্ষিত পালটা আক্রমণ চালাতে ইউক্রেনকে নতুন করে ভাবতে হবে। এই বাড়তি সময়টি রাশিয়া কীভাবে কাজে লাগায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

একদিকে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার তীব্রতা বাড়াচ্ছে, আর অপরদিকে যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশে সেনা অভিযান বাড়াচ্ছে ইউক্রেন।

বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধের শুরু থেকে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চেয়ে নেওয়ার পর এই তথাকথিত পাল্টা আক্রমণের সাফল্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে; ইউক্রেন ভবিষ্যতে পশ্চিমের পক্ষ থেকে কী পরিমাণ কূটনীতিক ও সামরিক সমর্থন পাবে।

Comments

The Daily Star  | English
Overall situation of foreign direct investment

Net foreign direct investment hits six-year low

The flow of foreign direct investment (FDI) in Bangladesh fell to $104.33 million in the July-September quarter of fiscal year 2024-25, the lowest in at least six years, as foreign investors stayed away from Bangladesh amid deadly political unrest, labour agitation, and a persistent economic crisis.

13h ago