কিয়েভে ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক, কার্যকর সফলতা আসার সম্ভাবনা কম
যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি সম্প্রতি ইউক্রেনকে ট্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিয়েভ এটিকে 'মোড় ঘোরানো' ঘটনা বলে দাবি করলেও সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে পূর্ণ বিজয়ের জন্য এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয় এবং এটি মূলত একটি প্রতীকী, রাজনৈতিক উদ্যোগ।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যম এনবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন ৩১টি অত্যাধুনিক এম ওয়ান আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় জার্মানি ১৪টি লেপার্ড টু ট্যাংক পাঠাতে সম্মত হয়েছে। ২ দেশের এই উদ্যোগে লেপার্ড-২ ট্যাংক ব্যবহার করে এরকম আরও ১৫টি দেশ ইউক্রেনকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
সুবিধা নয়, বরং অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে ট্যাংক
এ মুহূর্তে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের ২০ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে। ফলে এই ট্যাংকগুলো এসে পৌঁছালে তা আরেকটি নতুন লজিস্টিক সংকট তৈরি করতে পারে। এই ট্যাংক পরিচালনার জন্য সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং এগুলোর মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও লোকবলেরও প্রয়োজন হবে। এতে যুদ্ধ পরিচালনার খরচ ও জটিলতা উভয়ই বাড়বে। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো একটি ট্যাংক বিকল হয়ে গেলে সেটিকে সারানো খুবই ঝামেলাপূর্ণ হবে।
ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত 'রাজনৈতিক'
বিশ্লেষকদের মতে, এ মুহূর্তে ট্যাংক দেওয়ার বিষয়টি মূলত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এর অবদান শূন্যের কোঠায়।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের রুশ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক কেইর জাইলস বলেন, 'এসব উদ্যোগের কয়েকটি মোটা দাগে প্রতীকী।'
যুক্তরাজ্য ছোট একটি 'ট্যাংক প্যাকেজ' পাঠানোর অঙ্গীকার করে জার্মানিকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছে বলে জানান জাইলস।
'যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে আব্রামস ট্যাংক দিয়ে বলেছে, এটি তাদের দীর্ঘ মেয়াদী সক্ষমতা তৈরি করবে। এটি আগামী বসন্তে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বা হামলা চালানোর সক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন আনবে না', যোগ করেন এই বিশ্লেষক।
জাইলস আরও জানান, আর কিছু না হলেও, এই উদ্যোগের মাধ্যমে রাশিয়ার আপত্তিকে উপেক্ষা করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার ট্যাংক সক্ষমতার তুলনামূলক চিত্র
এ পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবধান তৈরি করেছে কামানের গোলা। তবে নিজ ভূখণ্ডের দখল ফিরে পেতে ইউক্রেনের ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বাড়ছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের সামরিক লজিস্টিকস বিষয়ের বিশেষজ্ঞ রনাল্ড টি জানান, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত রাশিয়া ১ হাজার ৩০০ ট্যাংক হারিয়েছে। প্রথাগত সামরিক মতবাদ অনুযায়ী, হামলাকারী বাহিনীর কাছে ৩ গুণ ট্যাংক বেশি থাকতে হবে। রাশিয়ার হাতে অনেক ট্যাংক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে ৩০-৪০টি ট্যাংক দেওয়া হলে তাতে স্বল্প মেয়াদে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো হেরফের হবে না।
কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদন মতে, রাশিয়ার হাতে আরও ২ হাজার ব্যাংক মুহূর্তের নোটিশে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় আছে। এছাড়াও, তাদের মজুতে আরও বিপুল পরিমাণ ট্যাংক রয়েছে।
২০২১ সালের সামরিক ভারসাম্য ডাটাবেজের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা ১০ হাজার ২০০ ট্যাংক মজুত রাখা আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু টি-৭২, প্রায় ৩ হাজার টি-৮০ এবং ২০০ টি-৯০ ট্যাংক রয়েছে।
একই ডাটাবেজের ২০১৬ সংস্করণে বলা হয়েছিল, স্নায়ু যুদ্ধের আমলের ২ হাজার ৮০০ টি-৫৫ ট্যাংক, ২ হাজার ৫০০ টি-৬২ ও ২ হাজার টি-৬৪ ট্যাংকও আছে তাদের হাতে।
অর্থাৎ, ৫০ এর দশকের শেষ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার ৩০০ ট্যাংক রয়েছে রাশিয়ার হাতে।
কিয়েভের জন্য আশার আলো
তবে এত কিছু সত্ত্বেও, কিয়েভের কর্মকর্তারা কয়েকটি দেশের কাছ থেকে একাধিক মডেলের ট্যাংক পাঠানোর উদ্যোগকে 'ট্যাংক জোট'হিসেবে অভিহিত করে একে স্বাগত জানাচ্ছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, ইউক্রেনকে রুশ আগ্রাসনের বিপক্ষে সফলভাবে প্রতিরক্ষা দিতে হলে অন্তত ৩০০ ট্যাংক প্রয়োজন। রাশিয়ার কাছ থেকে দখলীকৃত ভূখণ্ড ফিরিয়ে নিতেও এ পরিমাণ ট্যাংক যথেষ্ট হবে বলে তিনি মনে করেন।
ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ নামের গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, ইউরোপে এ মুহূর্তে ২০০ হাজার লেপার্ড-২ ট্যাংক আছে। জার্মানি, পোল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ জানিয়েছে, এ সপ্তাহের ঘোষণাতেই তাদের সহায়তা শেষ হচ্ছে না।
রনাল্ড টি আরও বলেন, 'সব মিলিয়ে, ইউক্রেন বসন্তে প্রতি-আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, যেটি শুধু জ্যাভলিন-২ এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সম্ভব নয়—এর জন্য ট্যাংক দরকার'।
নভেম্বরে খেরসন দখল ফিরিয়ে নেওয়ার মতো অন্যান্য শহর ফিরিয়ে নিতে লেপার্ড-২ ট্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মত দেন রনাল্ড।
বসন্তের যুদ্ধ ও ট্যাংকের গুরুত্বহীনতা
পশ্চিম ও ইউক্রেনের গোয়েন্দা বিভাগের সূত্ররা জানিয়েছে, আসন্ন বসন্তে রাশিয়া উত্তর-পূর্ব দিকের শহর খারকিভ দখল করার চেষ্টা চালাতে পারে। এমন কী, কিয়েভের দিকেও তাদের নজর রয়েছে। রুশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের কথোপকথনে আড়িপেতে এসব তথ্য বের করেছেন গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা।
তবে খারকিভ, কিংবা কিয়েভ দখলের মতো সামরিক সক্ষমতা এ মুহূর্তে রাশিয়ার নেই বলেই ভাবছেন বিশ্লেষকরা।
সিএনএনের এক প্রতিবেদন মতে, যুদ্ধ তুঙ্গে থাকা অবস্থায় রুশ কামান থেকে যতগুলো গোলা ছোঁড়া হচ্ছিল, এখন তার পরিমাণ ঊর্ধ্বে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, রাশিয়ার কামানের গোলার মজুত ফুরিয়ে আসছে এবং এখন আর আগের মতো অনিয়ন্ত্রিতভাবে তা খরচ করা হচ্ছে না।
এক সামরিক বিশেষজ্ঞ জানান, ইউক্রেনের বড় শহরগুলো দখল করতে এবং নতুন করে বড় আকারে হামলা চালাতে কামানের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।
সব মিলিয়ে, স্বল্প মেয়াদে ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে পাওয়া ট্যাংক কোনো নাটকীয় পরিবর্তন আনবে না বলেই ভাবছেন বিশ্লেষকরা।
তবে দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন প্রশিক্ষণ ও সহায়তা অব্যাহত থাকলে তা ইউক্রেনের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে বলেও মত দিয়েছেন।
Comments