সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এফবিআই এজেন্ট জর্জ পিরোর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা

সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এফবিআই এজেন্ট জর্জ পিরোর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা
বিচারের কাঠগড়ায় ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। ছবি: রয়টার্স

ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে আল কায়দার সম্পর্ক এবং দেশটিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগ এনে ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ইরাকে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ।

এরপর মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয় সাদ্দাম হোসেনকে। বিচার শেষে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এর আগে সাদ্দাম হোসেনকে দীর্ঘ সময় কারাবন্দি রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন লেবানিজ বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ও এফবিআই এজেন্ট জর্জ পিরো।

গতকাল বুধবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র মতামত অংশে প্রকাশিত পিটার বার্গেনের লেখার একটি বড় অংশজুড়ে আছে সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদকারী জর্জ পিরোর অভিজ্ঞতা। পিরোর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বার্গেন।

পিটার বার্গেন সিএনএন'র জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক। 'দ্য কস্ট অব ক্যাওস: দ্য ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড' বইটি তার লেখা।

পিটার বার্গেন তার মতামতে বলেন, 'প্রেসিডেন্টের (জর্জ বুশ) দাবির ফলে বেশিরভাগ আমেরিকান বিশ্বাস করেন যে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলায় জড়িত ছিলেন সাদ্দাম। যদিও এর স্বপক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছিল না। এমনকি দেশটিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্রও ছিল না।'

বার্গেন লেখায় উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথবাহিনী অল্প সময়ের মধ্যেই ইরাকি বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই যৌথ বাহিনীর ওপর বছরের পর বছর বিদ্রোহীদের হামলা চলতে থাকে। এরই মধ্যে ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইউএস স্পেশাল অপারেশন ফোর্সেস সাদ্দাম হোসেনকে খুঁজে পায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) বেছে নেয় বিশেষ এজেন্ট জর্জ পিরোকে। আরবি ভাষা জানাসহ আরও বেশ কিছু কারণে পিরোকেই সঠিক ব্যক্তি বলে মনে হয় এফবিআইয়ের কাছে। সাদ্দামের কাছ থেকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে সঠিক তথ্য বের করতে প্রচণ্ড চাপে ছিলেন পিরো।

বার্গেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় পিরো জানান, তিনি প্রায় ৭ মাস ধরে সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ধরে এই জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব চলত এবং সেই সময় কক্ষে তৃতীয় কেউ উপস্থিত থাকতেন না।

পিরোর বরাত দিয়ে বার্গেন দাবি করেন যে, ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না এবং আল কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন ও তার মতাদর্শ সাদ্দাম হোসেনের পছন্দ ছিল না।

বার্গেন লিখেছেন, 'পিরোর সঙ্গে স্বৈরশাসকের (সাদ্দাম হোসেন) আলোচনা নিশ্চিত করেছে যে ইরাক যুদ্ধ ছিল একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকার আসল পাপ—এমন যুদ্ধ, যা মিথ্যা অনুমান থেকে সংঘটিত হয়েছে, হাজারো আমেরিকান সৈন্য ও কয়েক লাখ ইরাকিকে হত্যা করেছে।'

'এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বে আমেরিকার অবস্থান ও দেশটির নাগরিকদের মধ্যে মার্কিন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমনকি সরকারিভাবে ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর ইতিহাস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে ইরাক যুদ্ধের প্রকৃত বিজয়ী আমেরিকা নয়। বিজয়ী ছিল... ইরান।'

সাদ্দাম হোসেন। ছবি: রয়টার্স

সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের শুরুর পর্ব সম্পর্কে বার্গেনকে পিরো জানান, তিনি যখন জানতে পারলেন সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, তখন তিনি 'আতঙ্কিত' হয়ে পড়েন।

পিরো বলেন, 'এটি এফবিআইয়ের পক্ষ থেকে পালন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে মনে হয়েছিল। আমি বার্নস অ্যান্ড নোবেলে গিয়ে সাদ্দাম হোসেনের ওপর ২টি বই কিনেছিলাম, যাতে তার সম্পর্কে নিজের জানাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারি এবং জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা তৈরি করতে পারি।'

সাদ্দাম সম্পর্কে নিজের ধারণার কথা জানিয়ে পিরো বার্গেনকে আরও বলেন, 'শৈশবের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই সাদ্দাম হোসেন কাউকে বিশ্বাস করত না এবং তিনি (সাদ্দাম হোসেন) নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন।

সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে পিরোর প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা ছিল এ রকম—'সাদ্দামের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে তিনি আমার সম্পর্কে ২টি ব্যাপার জানান। আমি তাকে বলেছিলাম আমার নাম জর্জ পিরো এবং আমি ইনচার্জ হিসেবে আছি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, "তুমি লেবানিজ"। আমি তাকে বলেছিলাম যে আমার বাবা-মা লেবানিজ। তারপর তিনি বললেন, "তুমি খ্রিস্টান"। আমি তার কাছে জানতে চাই, এতে কোনো সমস্যা আছে কি না। তিনি বলেন, "মোটেই না"। তিনি লেবাননের জনগণকে ভালোবাসতেন। লেবাননের মানুষ তাকে ভালোবাসত।'

সাদ্দামের সঙ্গে আলাপচারিতার বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমরা সবকিছু নিয়েই কথা বললাম। বিশেষ করে প্রথম কয়েক মাসে আমার লক্ষ্য ছিল তাকে দিয়ে কথা বলানো। আমি জানতে চেষ্টা করেছি তার জীবনে মূল্যবান কী এবং তার পছন্দ, অপছন্দ ও চিন্তাধারা। তাই আমরা ইতিহাস, শিল্প, খেলাধুলা থেকে শুরু করে রাজনীতি—সবকিছু নিয়েই কথা বলেছি।'

প্রথম জিজ্ঞাসাবাদে সাদ্দাম হোসেনের লেখা 'জাবিবা অ্যান্ড দ্য কিং' বই নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান পিরো।

সিআইএ সাদ্দামের ওপর 'কোয়ার্সিভ ইন্টারোগেটিভ প্রোগ্রাম' (জিজ্ঞাসাবাদের বিশেষ একটি ধরন) চালায়। এ সম্পর্কে পিরো সে সময় অবগত ছিলেন কি না জানতে চাইলে পিরো বার্গেনকে বলেন, 'আমি এ সম্পর্কে পরে জানতে পেরেছি এবং অবশ্যই আমি কখনোই এনহ্যান্সড ইন্টারোগেশন টেকনিক ব্যবহার করিনি, যেমনটি এসব ক্ষেত্রে হয়। এগুলো মার্কিন সংবিধান পরিপন্থী, এফবিআইয়ের নীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী। কাজেই আমার এগুলো দরকার হয়নি, কারণ আমি এগুলো কখনোই ব্যবহার করিনি, কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানি না এবং জানতে চাইও না।'

সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে প্রায় ১ বছর সময় কাটানোর অনুমতি এবং এই দীর্ঘ সময় নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পাওয়াকে 'সুবিধাজনক' ছিল বলে উল্লেখ করেন পিরো।

তিনি বলেন, 'আমরা সাদ্দামের কাছ থেকে কৌশলগত বিষয়গুলো জানতে চাইছিলাম। চাইছিলাম সেগুলো তিনি শেয়ার করুন। কাজেই একটি কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী জিজ্ঞাসাবাদ কৌশলই ছিল আমাদের মূল চাবিকাঠি।'

টুইন টাওয়ারে হামলা এবং আল কায়দার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের তথাকথিত সম্পর্ক নিয়ে পিরো বলেন, 'সাদ্দাম আমাকে বলেছিলেন যে তিনি ওসামা বিন লাদেনকে পছন্দ করেন না এবং পুরো আরব বিশ্বে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য থাকায় তিনি আল কায়েদার আদর্শে বিশ্বাস করেন না। সাদ্দামের ক্ষমতা হস্তান্তর করার বা অন্য কারও কাছে ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ওসামা বিন লাদেনকে নিয়ে সাদ্দাম রসিকতা করে বলতেন, "এই রকম দাড়িওয়ালা কাউকে বিশ্বাস করতে পারবেন না"। অন্য ইরাকি বন্দিরাও নিশ্চিত করেছে যে আল কায়েদার সঙ্গে তাদের কোনো অপারেশনাল সম্পর্ক ছিল না।'

ইরাকে সামরিক অভিযানের সময় সাদ্দাম হোসেনের একটি মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

সাদ্দাম হোসেনের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান সম্পর্কে পিরো বলেন, 'সাদ্দাম ইতিহাসের অন্যতম সেরা আরব মুসলিম নেতা হিসেবে বিবেচিত হতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে আরব মুসলিম ইতিহাসের তৃতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ভাবতেন।'

পিরোর ভাষ্য, 'সাদ্দাম সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ভাবতেন হযরত মোহাম্মদকে (সা.)। এই তালিকায় তার কাছে দ্বিতীয় ছিলেন সালাউদ্দিন আইয়ূবি। সুতরাং নিজেকে সেই ধরণের মহান নেতা ও যোদ্ধা হিসেবে চেনাতে সাদ্দামকে ধার্মিকতা দেখাতে হয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ।'

সাদ্দাম হোসেনের সরকারের এক সময়ের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজ ছিলেন খ্রিস্টান। সাদ্দাম কখনোই তাকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেননি এবং তার প্রাসাদ ও কার্যালয়ের বেশিরভাগ কর্মী খ্রিস্টান ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন পিরো।

গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের মন্তব্য সম্পর্কে পিরো বার্গেনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'তিনি আমাকে বলেছিলেন, "অবশ্যই ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নেই"। সাদ্দাম ২০০০ সালের জুনে একটি সমালোচনামূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে "ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে"।'

যদি সাদ্দামের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নাই-ই থাকে, তাহলে কেন তিনি সেটা বলতে গেলেন?

এ ব্যাপারে পিরোর উপলব্ধি হলো, 'তখন তার (সাদ্দাম হোসেন) সবচেয়ে বড় শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইসরাইল ছিল না। তার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল ইরান এবং তিনি আমাকে বলেছিল যে তিনি ইরানের সঙ্গে ভারসাম্য বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চেষ্টা করছিলেন। সাদ্দামের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, ইরান যদি জানে যে ইরাক কতটা দুর্বল ও অরক্ষিত, তাহলে দক্ষিণ ইরাকে আক্রমণ করা এবং দখল করা থেকে ইরানকে আটকানো যাবে না। তার লক্ষ্য ছিল ইরানকে দূরে রাখা।'

পিরো বলেন, '১৯৮৭ সালে ইরাক তেহরানের ভেতরে গুলি চালাতে এবং আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ইরানিরা এর জবাব দিতে পারেনি। কারণ তাদের কাছে ইরাকের অস্ত্রের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তাই তারা পাল্টা আঘাত করতে পারেনি। আর এটাই তেহরানকে নতজানু করে এবং আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য করে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ইরাকের অস্ত্র পরিদর্শনের মাধ্যমে সাদ্দাম ইরানিদের বুঝতে দিতে চাননি যে সেই ক্ষমতা তিনি হারিয়েছেন। তিনি তার সবচেয়ে বড় শত্রুকে ফাঁকি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে, তিনি তখনো ততটাই শক্তিশালী ও বিপজ্জনক, যতটা তিনি ১৯৮৭-৮৮ সালে ছিলেন।'

সাক্ষাৎকারে বার্গেন পিরোর কাছে জানতে চান, মার্কিন আক্রমণে সাদ্দাম হোসেন বিস্মিত হয়েছিলেন কি না? জবাবে পিরো বলেন, 'না, তিনি অবাক হননি। প্রাথমিকভাবে, তিনি ভাবেননি যে আমরা আক্রমণ করব। আপনি যদি ২০০২ সালের বেশিরভাগের দিকে তাকান, তিনি ধারণা করেছিলেন যে আমরা বিমান হামলা করতে যাচ্ছি, যেমনটি করেছিলাম ১৯৯৮ সালে। ডেজার্ট ফক্স নামের ওই অভিযানে ৪ দিনের বিমান হামলা থেকে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেপরোয়া ছিলেন। এরপর তিনি বুঝতে পারেন যে প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাক আক্রমণ করতে চান। তাই আক্রমণ ঠেকাতে তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং অস্ত্র পরিদর্শকদের ইরাকে প্রবেশের অনুমতি দেন। তিনি আমাকে জানান, সম্ভবত ২০০২ সালের অক্টোবর বা নভেম্বরের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন যে যুদ্ধ অনিবার্য এবং তারপরই নিজে, তার নেতাদের এবং সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে শুরু করেন।'

যুক্তরাষ্ট্র দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সাদ্দাম বাহিনীকে পরাজিত করে। এ বিষয়ে পিরো বলেন, 'সাদ্দাম আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি তার সামরিক কমান্ডারদের ২ সপ্তাহের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন এবং তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন, এর পরেই বিদ্রোহ শুরু হবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে।'

পিরোর জিজ্ঞাসাবাদের একটি অংশের ওপর ভিত্তি করে সাদ্দাম হোসেনের বিচার সম্পন্ন হয়। এ বিষয়ে সাদ্দাম হোসেনের স্বীকারোক্তি পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'নৃশংসতার জন্য তিনি দায়ী ছিলেন। আমরা কুয়েত আক্রমণ এবং কুর্দিদের ওপর গ্যাস হামলার বিষয়ে কথা বলেছি। সাদ্দাম এ বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং শুধু সাদ্দামই নয়, তার অন্যান্য অধস্তন নেতারাও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। আমরা এই ধরণের সব প্রমাণ সংগ্রহ করতে করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তার হামলায় বেঁচে যাওয়া সাক্ষীদের আমরা খুঁজে পাই ও চিহ্নিত করি। তারা আদালতে হাজির হতে ও সাদ্দামের অপরাধের সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হন এবং আমরা মামলার জন্য পর্যাপ্ত নথি ও অডিও উদ্ধার করি।'

জর্জ পিরো। ছবি: রয়টার্স

সাদ্দামের শাসনামলে ইরাকের শিক্ষাব্যবস্থাসহ সার্বিক বিষয়ের সঙ্গে মার্কিন আগ্রাসনের পর ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে পিরোর কাছে বার্গেন জানতে চান, '২০ বছর পরে এসে আপনার কি মনে হয় যে এই হামলার প্রয়োজন ছিল?'

জবাবে পিরো বলেন, 'এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। একজন এফবিআই এজেন্ট হিসেবে সৌভাগ্যক্রমে এ সম্পর্কে চিন্তা করার বা এদিকে ফোকাস করার অবস্থানে আমি ছিলাম না। আমার কাজ ছিল জিজ্ঞাসাবাদ করা।'

ইরাক যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা ছিল এবং এসব ব্যর্থতা না থাকলে আজকের ইরাক ভিন্ন রকমের হতো বলে মনে করেন পিরো। তার ধারণা, মার্কিন বাহিনীর সবচেয়ে বড় 'ব্যর্থতা' ছিল ইরাকের সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করা। কারণ, সামরিক বাহিনীর সবাইকে বরখাস্ত করে দেওয়ায় তারা সবাই অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এর ফলে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মার্কিন বাহিনী বিদ্রোহের মুখে পড়ে।

এফবিআইয়ের একজন এজেন্ট হিসেবে নয়, বরং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ইরাকের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চাইলে পিরো বলেন, 'আমি ইরাকের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী না। প্রথমত, ইরাকের এমন একজন নেতা প্রয়োজন যিনি ইরাককে সর্বাগ্রে রাখবেন। সাদ্দামের ভেতরে এটা ছিল—তিনি ইরাককে সর্বাগ্রে রেখেছিলেন এবং এক অর্থে সবাইকে একত্রিত করেছিলেন। এখন দেখেন তারা কতটা বিভক্ত। যতদিন পর্যন্ত কেউ এসে ধর্মীয় বা জাতিগত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ইরাককে একটি দেশ হিসেবে মনে না করবে, ততদিন তাদের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জিং থাকবে।'

সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির দৃশ্য টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। সেই দৃশ্য দেখেছেন পিরো। সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেওয়ার বিষয়টি তিনি উপভোগ করেননি। মৃত্যুদণ্ড নয়, পিরোর কাছে খারাপ লেগেছিল সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল সেটি। তার কাছে মনে হয়েছে, শেষ সময়ে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা ছিল প্রতিহিংসার মতো।

জর্জ পিরো জিজ্ঞাসাবাদের সময় সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তার আসন্ন মৃত্যুদণ্ডের বিষয়েও কথা বলেছিলেন। সেই সময়ের কথাও স্মরণ করেন পিরো।

সাদ্দাম হোসেনের যখন ফাঁসি কার্যকর করা হয়, তখনকার কথা মনে করে পিরো বলেন, 'যারা ফাঁসি কার্যকর করছিলেন, তারা সাদ্দামকে উপহাস করছিলেন। সাদ্দাম তাদের দেখে হেসেছিলেন এবং প্রার্থনা করছিলেন। তাকে ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিতে হয়নি এবং মুখ ঢেকে রাখার জন্য তিনি মুখোশ পরেননি। তিনি খুব প্রতিবাদী এবং এক অর্থে খুব শক্তিশালী বা সাহসী হিসেবে ফাঁসির মঞ্চে এসেছিলেন। এটিই মানুষ মনে রাখে, বিশেষ করে আরব বিশ্বের সুন্নি জনগোষ্ঠী।'

সাদ্দাম হোসেকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব শেষে জর্জ পিরো এফবিআইতে আরও বড় পদে অধিষ্ঠিত হন। অবসর নেন মিয়ামি ফিল্ড অফিসের বিশেষ এজেন্ট হিসেবে।

সাদ্দাম হোসেনকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে বইও লিখছেন পিরো।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

5h ago