লোকগবেষণা ও সৃষ্টিশীলতার অনন্য পথিকৃৎ আশরাফ সিদ্দিকী
ময়মনসিংহের অষ্টম শ্রেণির এক কিশোর নববর্ষ উপলক্ষে কিছু আঞ্চলিক বাংলা ধাঁধা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। সঙ্গে মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা একটি চিঠি। আঞ্চলিক ধাঁধা আর চিঠিটা পেয়ে কিশোরের মেধায় মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। তাই উত্তর জানাতে ভুল করলেন না। সঙ্গে ছিল তার আশীর্বাদ-বাণী। রবীন্দ্রনাথের ফিরতি চিঠি পেয়ে সে কিশোর আনন্দে আটখানা।
চিঠি পাওয়ার কিছুদিন পরই প্রয়াত হলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সেই কিশোরের মনোজগৎ থেকে বিচ্যুত হলো না রবীন্দ্রনাথ। বরং আরও ঘনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে ধরল। ততদিনে পত্র-পত্রিকা ও বইপত্রের মারফত সেই কিশোর জেনে গেছে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের শিক্ষা পদ্ধতি, সাংস্কৃতিক পটভূমি। যেখানে দেখা পাওয়া যায় প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের নিবিড় সংযোগ। তার মনেপ্রাণে ইচ্ছা শান্তিনিকেতনে পড়ার। একপর্যায়ে মনের আকুল আবেগে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের অধ্যক্ষকে চিঠি লিখল সেই কিশোর। অধ্যক্ষও সেই আবেগকে উৎসাহিত করলেন।
কিন্তু সেই কিশোরের বাবা-মা অনড়। কিছুতেই যেতে দেবেন না। কিন্তু একপর্যায়ে ছেলের জেদের কাছে বাধ্য হলেন তারা ছাড়তে। বাবা মায়ের উৎকণ্ঠাকে অগ্রাহ্য করে সেই কিশোর একদিন শান্তিনিকেতনের মাটিতে পা রাখল। সালটা ১৯৪৫। তখনো শেষ হয়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। শুরু হলো জীবনের এক অনন্য অধ্যায়।
যে কিশোরের কথা এতক্ষণ বলছিলাম তিনি আশরাফ সিদ্দিকী। একজন আশরাফ সিদ্দিকীকে কতো নামে সম্বোধন করা যায়। একাধারে কিংবদন্তী লোকগবেষক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক, লোকসাহিত্যিক ছিলেন তিনি। নিজের ৯৩ বছরের আয়ুষ্কালকে যিনি পরিণত করেছেন এক কিংবদন্তীময় ভাষ্যে। আপন কর্ম গবেষণা, আর রচনার মধ্য দিয়ে যিনি সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য দিগন্ত।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই কবিতার মধ্য দিয়ে প্রথম সাহিত্যে হাতেখড়ি হয় আশরাফ সিদ্দিকীর। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই তার কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে সওগাত ও পূর্বাশা সাহিত্য পত্রিকায়।
শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে অধ্যয়নের সময়ে বিখ্যাত সাহিত্যিকদের খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আশরাফ সিদ্দিকীর। তাদের মধ্যে ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, সৈয়দ মুজতবা আলী, পল্লীকবি জসীম উদদীন, সাগরময় ঘোষ, নরেন্দ্র দেব প্রমুখ। এছাড়া মহাত্মা গান্ধী, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আশরাফ সিদ্দিকীর।
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে স্নাতকে ভর্তিও হয়েছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী কিন্তু দেশভাগ হয়ে গেলে পড়াশোনা ছেড়ে ফিরে আসেন তিনি। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ টাঙ্গাইলের করটিয়ার সা'দত কলেজে। ছাত্র জীবনে চূড়ান্ত মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। স্নাতকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তার অবস্থান ছিল প্রথম।
তখন দেশভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু দেশভাগের তীব্র যন্ত্রণা, হাহাকার, দাঙ্গার প্রতিঘাত সমস্ত কিছুই দগদগে ক্ষত হয়ে আছে। চারদিকে কেবলই মৃত্যুর মিছিল। সেই পরিবেশেই অজস্র পরিবার বিদ্ধ। তালসোনাপুর নামের এমনই এক গ্রামের পরিবারের গৃহকর্তা ছিলেন তালেব নামের জনৈক শিক্ষক। তার হাত ধরে অনেক ছাত্র পেশাজীবনে সাফল্যের শিখরে পৌঁছান। এর পরও সেই শিক্ষকের পরিবারটিকে গ্রাস করে অভাব আর দারিদ্র্য। প্রতি মুহূর্তে অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে করতে একসময় তিনি হার মানেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে আত্মহত্যা করলেন। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনার পরও আশ্চর্য নিশ্চুপ চারপাশ। কেউ টুঁ শব্দটিও করল না। কলম উঠে এলো একজনের হাতে। তিনিই ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী।
আশরাফ সিদ্দিকীর অসামান্য বয়ানে তালেব মাস্টারের জীবন সংগ্রামে পরাজয়ের কথা উঠে এল। যেখানে আমরা দেখতে পাই এক শিক্ষকের করুণ জীবন। যে কবিতায় উঠে এসেছে তালেব মাস্টারের জীবনের এক দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। উঠে এসেছে সময়ের করুণ চিত্র। কবিতায় লেখা 'কত ছাত্র গেল এল-/প্রমোশন পেল/কিন্তু দশ টাকার বেশী প্রমোশন হয়নি আমার/ কপালে করাঘাত করেছিলাম জীবনে প্রথম সেবার।'
তালেব মাস্টারকে ইতিহাস মনে রাখেনি ঠিক, কিন্তু আশরাফ সিদ্দিকীর 'তালেব মাস্টার' কবিতাটি বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় সেই অসহনীয় মর্মবেদনার কথা। কবিতার একাংশে আশরাফ সিদ্দিকী লিখেছিলেন, 'ইতিহাস সবই লিখে রেখেছে রাখবে-/ কিন্তু এই তালেব মাস্টারের কথা কি লেখা থাকবে?/ আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা/ আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তু/ নিজের জীবনই অন্ধকারমালা।' ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা'। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই আলোড়ন সৃষ্টি করেন আশরাফ সিদ্দিকী।
শুধুমাত্র এই কাব্য গ্রন্থই নয়। পরে 'সাত ভাই চম্পা', 'বিষকন্যা', 'উত্তরের তারা', 'সহস্র মুখের ভিড়ে'র মতো কবিতার বই লিখেছেন আশরাফ সিদ্দিকী।
কথাসাহিত্যে আশরাফ সিদ্দিকীর মতো জীবন ঘনিষ্ঠ কথাশিল্পীর তুলনা পাওয়া ভার। গল্পকার হিসেবে তার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল 'রাবেয়া আপা' গল্পের মধ্যদিয়ে। তবে 'গলির ধারের ছেলেটি' তাকে আলোচনার মধ্যমণিতে পরিণত করে। গল্পটির মূল চরিত্র ছিল লাডু নামের এক ভিক্ষুক শিশু। কখনো মেডিকেল কলেজের গেটে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গেটে, কখনোবা সদরঘাট আর মিটফোর্ড হাসপাতালের গেটে তাকে পাওয়া যায়। গলির ধারে তিনটি ইট বিছিয়ে কুড়িয়ে আনা কাগজ খড়ি আর পাতা জ্বালিয়ে চলে তার ক্ষুদ্র সংসার। একদিন হঠাৎ জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে সে পড়েছিল পথের ধারে। হাসপাতালে জায়গা হয় তার। চিরকাল অপাংক্তেয় নোংরা উষ্কখুষ্ক চুলের ভিক্ষুক ছেলেটি হাসপাতালে ভালো সিটে থাকার সুযোগ পায়।
সকাল বিকেল ভালো খাবার পায় সে। একপর্যায়ে সুস্থ হয়ে উঠলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন চলে আসে। কিন্তু ছেলেটি চিরকাল হাসপাতালেই থাকতে চায়। সে দেখল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার মানে আবার সেই অনিশ্চয়তার জীবন। তাই সেদিন রাতেই ছেলেটি ভাঙা কাঁচের টুকরো দিয়ে নিজের পা হ্যাঁচকা টান দিয়ে কেটে ফেলে। এর ফলে আবার হাসপাতালে থাকার সুযোগ পায়। সুস্থ হয়ে ওঠার পর আবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। সে নার্সকে জিজ্ঞেস করে 'এমন কোন ওষুধ নেই, যেটা খেলে চিরদিন থাকা যাবে এখানে। শরীর ভালোও হবে না, বেশি খারাপও হবে না।' হাসপাতালের নার্সকে টিনচার আয়োডিনের শিশি দেখিয়ে ফের প্রশ্ন করতেই চূড়ান্ত বিরক্ত হন নার্স রোকেয়া।
বিরক্তির গলায় সে বলে, 'এমন একটি ওষুধ যা খেলে কোনদিন তোকে এখান থেকে যেতে হবে না। একবারে চিরদিনের জন্য থেকে যেতে হবে।' ওষুধের বোতলের গায়ে লেখা নামটি মুখস্থ করে রাখে ছেলেটি। শেষ রাতে হাসপাতালের সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় তখন হাসপাতালে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য নার্সের কথামতো আয়োডিন পান করে সে। ফলাফল সাক্ষাৎ মৃত্যু।'
আশরাফ সিদ্দিকী নিখুঁত ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে পথশিশুদের জীবনের যে করুণ ও মানবিক গল্পটি তুলে এনেছেন তা সচরাচর আমাদের কথাসাহিত্যে উঠে আসে না। গল্পটির মধ্য দিয়ে আশরাফ সিদ্দিকী এক অনন্য নজিরও স্থাপন করেছেন। আশরাফ সিদ্দিকীর কালজয়ী এই গল্পটি অবলম্বনে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেছিলেন 'ডুমুরের ফুল' নামের অসামান্য এক শিশুতোষ চলচ্চিত্র। আশরাফ সিদ্দিকীর সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ 'শেষ নালিশ' ও শক্তিমান কথাসাহিত্যের অনন্য উদাহরণ। তার লেখা উপন্যাস 'শেষ কথা কে বলবে', 'আরশী নগর' ও 'গুনীন' কালোত্তীর্ণ।
আশরাফ সিদ্দিকীর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় পাওয়া যায় কিশোর বয়সেই। যা ধীরে ধীরে পরিপক্ব হয়েছে লোকসাহিত্যের সঙ্গে তার সংযোগের মাধ্যমে। কিশোর বয়সে নববর্ষ উপলক্ষে কিছু আঞ্চলিক বাংলা ধাঁধা সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথও। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন লোকসাহিত্যের সঙ্গে বৃহৎ পরিসরে সংযোগ ঘটে আশরাফ সিদ্দিকী। পরবর্তী জীবনে আশরাফ সিদ্দিকী লোক সাহিত্যের গবেষণায় এনেছেন এক প্রাণোচ্ছল উদ্যম। লোকসাহিত্যকে তিনি কেবল গবেষণার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং শিকড় সন্ধানী এক যাত্রার পরিচয়ের খোঁজ প্রকাশ করেছেন। লোকসাহিত্যের গবেষণায় তিনি যে প্রাণের সঞ্চার করেছেন তা অতুলনীয়।
আশরাফ সিদ্দিকীর 'কিংবদন্তির বাংলা', 'শুভ নববর্ষ' 'লোকায়ত বাংলা', 'আবহমান বাংলা', 'বাংলার মুখ' পড়লে বোঝা যায় তিনি কতোখানি সুলুক সন্ধানী ছিলেন। লোক ঐতিহ্য এবং আমাদের গ্রামবাংলার আবহমান সাংস্কৃতিক পরিচয়কে অনেকাংশেই উন্মোচিত করেছেন আশরাফ সিদ্দিকী।
আশরাফ সিদ্দিকীর প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ পিএইচডি ডিগ্রি ছিল লোকসাহিত্যের উপর। তিনি ছিলেন লোকসাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক গবেষক। কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক রূপেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থাতেই তিনি লিখেছিলেন 'সিংহের মামা ভোম্বল দাস' নামের অসামান্য এক শিশু সাহিত্য।
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় আশরাফ সিদ্দিকী সংযুক্ত ছিলেন বাংলা একাডেমিতে। ছয় বছর একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। ছিলেন বাংলাদেশ ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বেও। কিন্তু তাতে ছেদ পড়েনি তার সৃষ্টি ও সংকলন কর্মে।
আশরাফ সিদ্দিকীর জীবনের একটি অংশজুড়ে ছিল শিক্ষকতা। শিক্ষকতা জীবনে তিনি অধ্যাপনা করেছেন টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ, রাজশাহী কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। শেষদিকে অধ্যক্ষ ছিলেন জগন্নাথ কলেজের। অধ্যাপনা জীবনেও আশরাফ সিদ্দিকী ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন লোকসাহিত্যের প্রতি মমত্ববোধ ও শিকড়সন্ধানী মননশীলতা।
আশরাফ সিদ্দিকী পরম মমতায় তুলে এনেছেন বাংলার লোককাহিনি, ছড়া, লোক পুরাণ, আঞ্চলিক গীতিকা। বিচরণ করেছেন লোক সাহিত্যের সমস্ত অঙ্গনে। শৈশবে মায়ের কাছে শোনা রূপকথার গল্পকে আশরাফ সিদ্দিকী তুলে এনেছেন 'বাংলাদেশের রূপকথা' নামক গ্রন্থে।
আশরাফ সিদ্দিকীর জীবন দর্শন বরাবরই ছিল লোকজ এবং লোকায়ত ঘনিষ্ঠ। যিনি লোকসত্তাকে লালন করেছেন, ধারণ করেছেন, হারানো লোকসাহিত্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। কিন্তু কেবল লোকসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি বিচরণ করেছেন এক সৃষ্টিশীল জগতে, যে জগত তাকে স্মরণীয় করে রাখবে।
চার বছর আগে আজকের দিনেই চলে গিয়েছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্য সূত্র:
রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন/ ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী
বাংলাদেশের লোক সাহিত্য ও ঐতিহ্য/ ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী
Comments