ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

পরিবারের বড় ভাই যেভাবে সবার ‘বড় ভাই’ হয়ে উঠলেন

১৯৭৭ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী
১৯৭৭ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

মানুষকে ভালোবেসে সবহারাদের সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি। রাজকীয় জীবনযাপন ছেড়ে, ব্যক্তিগত লোভ-লাভের মোহ-মায়া ত্যাগ করে নেমে এসেছিলেন সাধারণের কাতারে।

মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকালে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে পাওয়া যায় দেশের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে। আবার স্বাধীন দেশে তিনিই হয়ে ওঠেন স্বাস্থ্যসেবা, নারীপ্রগতি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার নায়ক। তার চিন্তাজুড়ে ছিল গণমানুষের জন্য কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। আর নিজ হাতে গড়ে তোলা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিবিধ জনমুখী কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পরিচিতির রূপরেখা তৈরিতে তার কর্মমুখরতা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

ভীতু ও আপসকামী মননের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে এই 'গরিবের ডাক্তার' ছিলেন নিঃসঙ্গ-লড়াকু এক সৈনিক। গত ১২ এপ্রিল দৈহিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যার যুদ্ধ চলমান ছিল। তাই কখনো কখনো তাকে মনে হয় ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা পৌরাণিক কোনো চরিত্র।

এক ফ্রেমে ১০ ভাইবোন। (উপরের সারিতে বা থেকে) ছোট বোন সেলিনা চৌধুরী মিলি, মেঝ বোন নাছিমা চৌধুরী, বড় বোন লেখক আলেয়া চৌধুরী, সেজ বোন খালেদা মোর্শেদ মিনু, চতুর্থ বোন নিলুফার মোর্শেদ ঝিনু। (নিচের সারিতে বা থেকে) ছোট ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদউল্লাহ চৌধুরী, মেঝ ভাই কর্নেল নাসির চৌধুরী, বড় ভাই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সেজ ভাই নাজিম উল্লাহ চৌধুরী, চতুর্থ ভাই ইকরাম উল্লাহ চৌধুরী। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গনস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল মিলনায়তনে পারিবারিক অনুষ্ঠানে তোলা ছবি।

অনেকের ভাষ্য, সাভারে বিশাল আয়তনের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করেছেন দরদি বীর জাফরুল্লাহ। এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন, একসঙ্গে এক টেবিলে একই ধরনের খাবার খান। এখানে সবাই কর্মী। আর তিনি ছিলেন তাদের সবার বড় ভাই।

এই মানুষটিই তার পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন? ১০ ভাই-বোনের বড় সংসারে তার ভূমিকাই বা কেমন ছিল? কেমন ছিল তার মৃত্যুর আগের কয়েকটি দিন?

এগুলো নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বোন আলেয়া চৌধুরীর সঙ্গে।

পরিবারে বাবার পরেই ছিল তার স্থান

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রামের রাউজানে ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।

ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসাপাতালে ডা. জাফরুল্লাহর বোন আলেয়া চৌধুরী। ছবি: মামুনুর রশীদ

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ১০ ভাইবোনের মধ্যে আলেয়া চৌধুরীর অবস্থান চতুর্থ। তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজে ২৬ বছর অধ্যাপনা করেছেন। এখন অবসর জীবনে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত।

গত সোমবার ডা. জাফরুল্লাহর গড়ে তোলা ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে বসে আলাপচারিতায় আলেয়া চৌধুরী বলেন, 'পরিবারে বাবার পরেই তার স্থান। আমাদের ৯ ভাইবোনকে দেখাশোনা করা, বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেওয়া- সবকিছু তিনি করেছেন। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে তার কোনো ঘাটতি ছিল না।

'ভাইবোনের প্রতি ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। ক্লাস সিক্স-সেভেন থেকে তিনি আমার পরীক্ষার ফি অনেকবার দিয়েছেন। কাপড়-চোপড় কিনে দিয়েছেন। অন্য ভাইবোনকেও দিয়েছেন।'

গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে আলেয়া চৌধুরী পড়তেন পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড এলাকার মুসলিম গার্লস স্কুলে। পরে যেটি আনোয়ারা বেগম মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ হিসেবে পরিচিত হয়। ডা. জাফরুল্লাহ তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র।

ডা. জাফরুল্লাহর বাবা হুমায়ূন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বকশীবাজারে থিতু হয়েছিলেন তিনি।

আলেয়া চৌধুরী বলেন, 'আমি স্কুলের হোস্টেলে থাকতাম। আমাকে দেখতে যেতেন তিনি। তিনিই মূলত দেখাশোনা করতেন আমাদের। আব্বা হয়তো মির্জাপুর থানায় ছিলেন, কুলিয়ারচর থানায় ছিলেন। পূর্বধলায় ছিলেন।'

মা হাসিনা বেগম চৌধুরীর সঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাবা হুমায়ূন মোর্শেদ চৌধুরী রচিত ‘আমাদের কাল আমার কথা’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া ছবি।

মায়ের প্রভাব

ডা. জাফরুল্লাহর ওপর মা হাসিনা বেগম চৌধুরীর প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আলেয়া চৌধুরী বলেন, 'আমার মায়ের চিন্তাভাবনা অনেক সুদূরপ্রসারী ছিল। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। কেবল আমাদের ১০ ভাইবোনকে ভালোবাসেননি। আমাদের সব আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আমার মায়ের স্নেহধন্য ছিলেন। আমাদের বাড়িতে এসে কেউ কখনো খালি মুখে যাননি।

'বকশীবাজারে আমাদের বাসাটি ছিল সবার আড্ডাস্থল। এখনকার অনেক বিখ্যাত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এমপি, সমাজকর্মীরা আমাদের বাসায় আসতেন। তারা সবাই ছিলেন বড় ভাইয়ের বন্ধু। আমার মাক তখন থেকেই বলতেন, মানুষের গুণগুলোকে জাহির করবে। দোষ ঢেকে রাখবে। সমাজকে ভালোবাসবে, দুখী মানুষকে ভালোবাসবে।'

ডা. জাফরুল্লাহর কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পূর্বশর্ত ছিল—প্রার্থীকে অবশ্যই অধূমপায়ী হতে হবে। মায়ের আদেশেই তিনি ধূমপান থেকে বরাবর বিরত ছিলেন বলে জানান আলেয়া চৌধুরী। বলেন, 'বড় ভাই বিলেতে যাওয়ার সময় মা বলে দিয়েছিল, "কোনোদিন তুমি ধূমপান করবে না। সিগারেট হাতে নেবে না।" আমাদের মায়ের সেই আদেশ সারাজীবন শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন বড় ভাই। তার গড়ে তোলা সব প্রতিষ্ঠানেও ধূমপান নিষেধ।

'বড় ভাই যখন ডাক্তারি পড়া শুরু করলেন মা তাকে বলে দিয়েছিলেন, "তুমি শুধু ডাক্তার হবে না। দুখী মানুষের ডাক্তার হবে। সাধারণ মানুষের ডাক্তার হবে। মানুষ যাতে সুলভে ওষুধ পায়, চিকিৎসা পায় সেটার ব্যবস্থা তুমি করবে। তোমার কাছে আমার আবদার থাকল। আমার জাফরুল্লাহ এভাবেই বড় হোক। আমি এটাই চাই"।'

ডা. জাফরুল্লাহ ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে সময়কার কথা স্মরণ করে আলেয়া চৌধুরী বলেন, 'বড় ভাই যখন মেডিকেলের জিএস ছিলেন তখন কয়েকবার আমি সেখানে গিয়েছি। ভাই চায়ে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে খেতেন। তার আশাপাশে অনেক মানুষের ভিড় থাকত। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতেন, সমীহ করতেন। এ বিষয়টা আমি খুব উপভোগ করতাম।

'অনেক রাত পর্যন্ত মেয়েদের নিয়ে কাজ করতেন বড় ভাই। সে সময় সেই দৃশ্যটাও আমি দেখেছি। ৬২-৬৩ সালে বিষয়টা খুব সহজ ছিল না।'

বাবা হুমায়ূন মোর্শেদ চৌধুরী ও মা হাসিনা বেগম চৌধুরীর সঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: হুমায়ূন মোর্শেদ চৌধুরী রচিত ‘আমাদের কাল আমার কথা’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।

শেষ সময়ের স্মৃতি

গত ৫ এপ্রিল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন ডা. জাফরুল্লাহ। এর আগে ১৬ মার্চ থেকে তার সঙ্গে ছিলেন আলেয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, 'প্রতিদিন ২ বার করে হাসাপাতালে এসেছি। তাকে খাইয়েছি। মধুভাত খেতে চেয়েছিলেন। সেটা খালি খাওয়াতে পারিনি। ৪টা রোজা রেখেছিলেন। আমার সেজভাবি গুলশান থেকে তার জন্য খাবার আনতেন। আমি, আমার বোনেরা পুডিং, ফালুদা, স্যুপ এগুলো আনতাম। শেষদিকে বলতেন, "তোমরা ভাইবোনরা এক হয়ে থাকবে। আমার গণস্বাস্থ্যটাকে দেখবে। তোমাদের হাতে দিয়ে গেলাম"।'

আলেয়া চৌধুরী আরও বলেন, 'উনি বলতেন, "মে মাসে আমাকে কিন্তু আর পাবে না। এপ্রিল পর্যন্তই আছি।" এটা উনি কয়েকবার বলেছেন। আমার অন্য বোনরাও শুনেছে।'

মায়ের প্রতি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে আলেয়া চৌধুরী জানান, '২০০৮ সালে আমাদের বাবা মারা যান। সে সময় থেকে পরবর্তী ৪০দিন বড় ভাই লুঙ্গি পরে প্রতিদিন ধানমণ্ডি থেকে বকশীবাজারে আমার মাকে দেখতে গেছেন।

'মা থাকতেন বকশীবাজারের বাড়িতে। বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি। বাড়ি বিক্রির টাকায় আমরা মা-বাবার নামে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বৃত্তি দেই, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে একটা বৃত্তি দেই। আর এখানে (গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল) একটা বেড দিয়েছি ২৫ লাখ টাকার।'

মৃত্যুর পরেও ডা. জাফরুল্লাহর গড়া প্রতিষ্ঠান ও তার নিজের কাজের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন আলেয়া চৌধুরী। বলেন, 'আমরা চাইব বড় ভাইয়ের স্মৃতি বেঁচে থাকুক। সবাই তার মতো সৎ হবে, সাহসী হবে। মানুষকে ভালোবাসবে। এটাই তার চাওয়া ছিল।'

দেশের বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগ ও রাজনৈতিক সংকটে ডা. জাফরুল্লাহ সর্বদাই নির্ভীক থেকে সত্য বলে গেছেন, প্রতিবাদী হয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা দরকার ছিল বলেও মনে করেন আলেয়া চৌধুরী। বলেন, 'উনি যদি আর একটি বছরও আয়ু পেতেন তাহলে হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতি কিংবা নির্বাচন নিয়ে যা চলছে তাতে একটা ভূমিকা রাখতে পারতেন। এর আগেও তিনি এমনটা বহুবার করেছেন।'

Comments

The Daily Star  | English
price hike of essential commodities in Bangladesh

Essential commodities: Price spiral hits fixed-income families hard

Supply chain experts and consumer rights activists blame the absence of consistent market monitoring, dwindling supply of winter vegetables, and the end of VAT exemptions granted during Ramadan.

14h ago