ডা. জাফরুল্লাহ বাংলাদেশের এক নতুন পরিচয় উন্মোচন করে গেছেন

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। পত্রিকায় তার বড় বড় দাবিগুলো আমরা আর দেখব না। তার অসুখের খবরও আর আমরা কদিন পর পর দেখব না। তিনি দেশের কাছে একটা স্থায়ী স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবেন।

ডা. জাফরুল্লাহকে আমরা একেকজন একেকভাবে মনে রাখব, যেহেতু তার বহু পরিচয়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমার কাছে তার যে পরিচয় ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, সেটা হলো ডা. জাফরুল্লাহ সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের নতুন পরিচিতির রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। যে বাংলাদেশের পরিচয় তিনি উন্মোচন করে দিয়ে গেছেন, সে বাংলাদেশ কোনো বাধা মানে না। সে বাংলাদেশ পুরোনোর কোনো আবরণে ঢাকা পড়তে নারাজ। সে বাংলাদেশ নিজের রাস্তা নিজের মতো করে বের করে নেওয়ার সন্ধানে ছুটতে জানে। তার আত্মবিশ্বাস নক্ষত্রছোঁয়া।

তরুণ জাফরুল্লাহ এককভাবে ছুটে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। কে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কী হিসাব মেলাচ্ছে, কী ব্যাখ্যা দিচ্ছে, কোনো কিছুর ধার ধারেননি তিনি। নিজেই নিজের ভূমিকা ঠিক করে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল লাগবে? তাই হবে। কী আছে, কী নাই, তার হিসাবের অপেক্ষায় কিছুই আটকে থাকবে না। জাফরুল্লাহ বাধা মানতে জানেননি কখনো। তিনি তার পেশাকে অবলম্বন করে যাত্রা শুরু করেছেন, কিন্তু পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি মোটেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করেছেন, কিন্তু নিশ্চিত করেছেন রোজ ভোরে কেন্দ্রের সবাইকে নিয়ে খেতে চাষ করা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সবস্তরের সিকিউরিটির জন্য প্রহরী দিলেন নারীদের। কোনো পুরুষকে এ কাজে নেওয়া হয়নি। তার গাড়িতে সার্বক্ষণিক নারী ড্রাইভার। ঢাকা-সাভারসহ সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন তার নারী ড্রাইভার নিয়ে। সমালোচনা হচ্ছে? জাফরুল্লাহকে কোনো সমালোচনা কাবু করতে পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার খবর সংগ্রহ করেছি আগ্রহ নিয়ে। সবাইকে জানিয়েছি তার খবর। তিনি ছিলেন আমাদের আশার প্রতীক। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আসলাম। আসার সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গঠিত বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি বিখ্যাত স্থপতি ডা. এফ আর খান একটা অবৈতনিক দায়িত্ব দিলেন। আমি তার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করব। আমি সোৎসাহে রাজি হলাম। প্রথম কাজ করলাম ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে দেখা করে তার একটা প্রজেক্টে অর্থ সহায়তা দেওয়া।

সাভারে গেলাম। খালি মাঠে কয়েকটি তাঁবু নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সমবয়সী অদ্ভুত এক যুবকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ। তার কাজের কোনো সীমা নেই। সেই থেকে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তারপর জাতীয় ওষুধ নীতি নিয়ে গভীরতর সম্পর্ক। তিনি আমাকে ওষুধ নীতি প্রণয়নের কমিটিতে নিলেন। সে এক অসম্ভব কাজ। জাফরুল্লাহর অসম্ভব সব স্বপ্ন। সব ওষুধ দেশে তৈরি করতে হবে। ইচ্ছা করলেই যেকোনো ওষুধ তৈরি করা যাবে না। ওষুধের দাম সরকার ঠিক করে দেবে। বিদেশি বিশাল ওষুধ কোম্পানি এবং তাদের দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সদ্য জন্মলাভ করা দরিদ্র এক দেশের মুখোমুখি সংঘাত। কিছুই মানেননি ডা. জাফরুল্লাহ। অবাক হয়েছি তার দৃঢ়তা এবং তথ্য-যুক্তির প্রয়োগে। তার কারণে ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ একটা নেতৃস্থানীয় শক্তিতে পরিণত হলো। এ কাজ করতে গিয়ে বহু বিপরীত শক্তির মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তাকে কাবু করতে পারেনি কেউ।

গরিব নারীদের প্রতি তার সহমর্মিতা তিনি তার সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের নারীদের ওপর যখন দুর্যোগ নেমে আসে, তখন তিনি সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য এককভাবে এগিয়ে এসেছিলেন।

গরিব মানুষের কাছে সুলভে উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া তার কর্মকাণ্ডের মূল সুর ছিল। এটা করতে স্বাস্থ্যসেবা বলতে কী বোঝায়, সেটাও তিনি নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছেন তার প্রতিটি পদক্ষেপের মাধ্যমে। নিজে ডায়ালাইসিসের রোগী হয়ে আবিষ্কার করলেন এক বিরাট অভাবের ক্ষেত্র। অসুস্থ হয়ে যখন তিনি সপ্তাহে ৩ বার ডায়ালাইসিস করছেন, তখন উদ্যোগ নিলেন ডায়ালাইসিস সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য। না, নিজের সুবিধার জন্য নয়, গরিব মানুষকে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে ডায়ালাইসিস করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এটা ছিল এক কঠিন কাজ। কিন্তু তার অসুখ এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে এ কাজটা সুসম্পন্ন করে দিয়ে গেছেন।

স্বাস্থ্যসেবা বলতে কী বোঝায়, সেটা ডাক্তার তৈরি করা থেকে শুরু করে ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি, রোগীর সেবা আগাগোড়া সব কিছুই নিজের বিশ্বাসের ওপর গড়ে তোলা কাঠামো দিয়ে তৈরি করে গেছেন। স্রোতের বিপরীতে যাওয়া যে কত কঠিন কাজ, সেটা জীবনের প্রতিদিন তিনি অনুভব করেছেন। কিন্তু তা থেকে কিছুই তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

তার নিজের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করে দিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কঠিন সব নিয়ম। কোনো ধূমপায়ীকে এখানে চাকরির জন্য দরখাস্ত করার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হবে না। তিনি গাছ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের ফার্নিচার তৈরি করার জন্য একটা কারখানা স্থাপন করলেন। ফাইবার গ্লাসের ফার্নিচার তৈরি হবে। বাইরের কেউ ফার্নিচার তৈরি করতে চাইলে সাগ্রহে তা করে দেবেন। কারখানার বৈশিষ্ট্য হলো সব কর্মচারী-শ্রমিক, ব্যবস্থাপক সবাই নারী। এর ব্যতিক্রম করা যাবে না। আমরাও আমাদের জন্য ফাইবার গ্লাস ফার্নিচার তৈরি করে নিলাম এই কারখানা থেকে।

যেসব কাজ নিয়ে জাফরুল্লাহ তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন, তার তালিকা করলে তালিকাটি দীর্ঘ হবে। কিন্তু আমি এই তালিকার দৈর্ঘ্য নিয়ে যতটা অবাক হয়েছি, তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, প্রত্যেকটা কাজ তিনি ভিন্নভাবে তার নিজস্ব নিয়মে করেছেন।

অবলীলাক্রমে পুরোনো নিয়ম ভাঙার এবং নতুন নিয়ম গড়ার, অজানা নিয়ম চালু করার এক অপূর্ব শিল্পী ডা. জাফরুল্লাহ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। জাতি চিরদিনের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে।

Comments

The Daily Star  | English
explanations sought from banks for unusual USD rates

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago