বিলিভ ইট অর নট

বিজ্ঞাপন যেভাবে বিপন্ন করে তুলেছিল একটি ভাষাকে

বিজ্ঞাপন যেভাবে বিপন্ন করে তুলেছিল একটি ভাষাকে
ছবি: সংগৃহীত

আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের কথা। ২০১৪ সাল। আয়াপানেকো নামে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা একটি ভাষা নিয়ে সরব হলো সংবাদমাধ্যম। মেক্সিকোর তাবাসকো প্রদেশের মাত্র দুজন মানুষ নাকি জানেন ওই ভাষা! তবে কোনো কারণে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে। কথা বলা বন্ধ। কিন্তু ভাষাটিকে তো বাঁচাতে হবে! 

তাই জার্মান কোম্পানি ভোডাফোনের উদ্যোগে তারা দুজন আবার কথা বলতে শুরু করেন। বেঁচে থাকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ভাষাটি। ঘটনাটি প্রচার পেয়েছিল এভাবেই। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সত্য ছিল না। 

এই ঘটনার আরও ৬ বছর আগে, ২০০৮ সালে ওই ভাষার অভিধান প্রণয়নের কাজও শুরু হয়েছিল। ওই বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করা একজন ইসিদ্রো ভেলাজকুয়েজকে মেক্সিকান সরকার নিযুক্ত করে ভাষাটি শেখানোর কাজে। নিজের ছেলে ও আরও ৪ জনকে তখন থেকে এই ভাষা শিখিয়েছিলেন ভেলাজকুয়েজ। 

বিজ্ঞাপনে অংশ নেয়া সেই দুজন। ছবি: সংগৃহীত

এর কয়েক বছর পর বিজ্ঞাপনী সংস্থা জাং ফন ম্যাট ভোডাফোনের জন্য একটি বিজ্ঞাপন বানানোর উদ্যোগ নেয়। তারা দুজন ব্যক্তির ভেতর কাল্পনিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেন স্টোরিলাইনের অংশ হিসেবে বিজ্ঞাপনের স্বার্থে। এই দুজনের ভেতর একজন ইসিদ্রো ভেলাজকুয়েজ, আরেকজন ম্যানুয়েল সেগোভিয়া। 

গল্প অনুযায়ী, বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, বিপন্ন একটি ভাষাকে বাঁচানোর জন্য নিজেরদের দ্বন্দ্ব ভুলে ভোডাফোনের উদ্যোগে তারা কথা বলতে শুরু করেন! কিন্তু ব্যাপারটি আগাগোড়াই ছিল সাজানো। অভিধান প্রণয়নের কাজে ইতোমধ্যে নিয়োজিত ভাষাবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল সুসলাক ওই দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা জানান, প্রকৃত ঘটনাটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও ক্লায়েন্টের কাছে আকর্ষণীয় লাগেনি। তাই অর্থ দিয়ে তাদের বলা হয় সাজানো স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী অভিনয় করতে! বাকি যারা ভাষাটি জানতেন তাদেরও অর্থ দিয়ে প্রজেক্ট থেকে দূরে রাখা হয়। 

এ নিয়ে অংশগ্রহণকারী দুজনও বিব্রত হন। ক্যাম্পেইনের প্রয়োজনে গল্প সাজানো হলেও সেটিকে সত্য মনে করে মিডিয়াগুলো সেখানে সাক্ষাৎকারের জন্য ভিড় জমাতে থাকে। 

জনাথন রেঙ্গেল নামে আরেকজন ভাষাবিদের মতে, 'শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোই নয়, বরং অন্যান্য ভাষা সংরক্ষণের জন্যও এটি বিপদজনক। যাদের এই ভাষা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, এর বাঁচা-মরায় যাদের কিছুই যায় আসে না, তাদের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করা হয়েছে। যে দুজন এই বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে দেখা করতে, সাক্ষাৎকার নিতে নিত্যদিন মিডিয়ার ভিড় হয়েছে। এমন গুজবও রটেছে, মিডিয়ার আনুকূল্য পাবার জন্যই নাকি এই ভাষাটি নতুন করে তৈরি করা হয়েছে!' 

সুসলাকের মতে, 'এই ভাষা শেখার তেমন কোনো আগ্রহ জার্মানদের থাকার কথা নয়। তাই তাদের অল্প কিছু কথা না শিখিয়ে বরং, এই সম্প্রদায়ের শিশুদের আয়াপানেকো শেখালে তা অর্থবহ হতো।' 

মেক্সিকোর তাবাস্কো প্রদেশের আয়াপা নামের একটি এলাকায় মূলত ওই ভাষাটির প্রচলন আছে। ভাষাটি প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো। ভাষাবিজ্ঞানী সুসলাকের মতে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই ভাষাভাষীর সংখ্যা কখনোই ৫০০ এর বেশি ছিল না। বিজ্ঞাপনে যেভাবে এর বিভিন্ন দেশজুড়ে বিস্তৃতির কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবে তার চেয়ে খুব অল্প জায়গায় এই ভাষার চর্চা ছিল। এখানে মায়ান, অ্যাজটেক, স্প্যানিশ ভাষার প্রচলন ছিল। কালক্রমে আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে আয়াপানেকো আরও দুর্লভ হয়ে পড়ে। 

রেঙ্গেলের মতে, ভাষাটি কাব্যিক। 'তোমার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠুক'- এ ভাষায় বলেন, 'জাআ'আ নিয়াইমি।' ধন্যবাদকে বলা হয়, 'দাইয়াস ইয়ুজা।' 

বিজ্ঞাপনে আকর্ষণীয় একটি মনগড়া ঘটনা দেখানোর প্রেক্ষিতে স্বল্পপ্রজ এই ভাষাটিকে মৃতপ্রায় মনে করেছিলেন অনেকেই। সুসলাক ও রেঙ্গেলের ধারণা, এই ভাষায় এই কথা বলতে পারেন ১৫ জনের মতো মানুষ। কাজেই এটি একেবারে মৃতপ্রায় না হলেও বাস্তবিকই বিপন্ন একটি ভাষা। বাসাবাড়িতে পারিবারিকভাবে এর কোনো চর্চা নেই। যারা শিখেছেন তারা মূলত ভাষাটির চিরতরে হারিয়ে যাওয়া রোধ করতেই শিখেছেন। তারা শহরের তরুণদের বেশ কয়েকজনকে এখন ভাষাটি শেখাচ্ছেন। আয়াপানেকো নিয়ে 'ভাষা প্রতিযোগ' ও 'ভাষা উৎসব'-এর মতো আয়োজনও করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। 

 

তথ্যসূত্র: রিপলি'স বিলিভ ইট অর নট

গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

 

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

12h ago