যে কারণে জাপানে জন্মহার কম
জাপানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০০০-এর দশকের শেষদিকে ছিল প্রায় শূন্য। ২০১০ সালের দিকে এসে এই হার নিম্নমুখী হতে শুরু করে আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসে এই নিম্নমুখী হার যেন আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।
গত ১০ বছরে নিম্ন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে জাপান প্রতি বছর নিজের রেকর্ড ভেঙেছে। ২০২০-২১ সালে দেশটি আরও ৬ লাখ ৪৪ হাজার মানুষ হারিয়েছে, যেটি আরেকটি রেকর্ড। ১৯৫০ সালের পর থেকে দেশটিতে বর্তমানে শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে কম।
জাপান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে দেশটিতে ১৪ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সী শিশুর সংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৪৬ লাখ। দীর্ঘায়ু এবং নিম্ন প্রজনন হারের কারণে দেশটিতে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অভাব দেখা দিয়েছে এবং সরকারের জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন খরচের খাতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
জাপানের মতো একইরকম সংকট মোকাবিলা করছে এই অঞ্চলের তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এ ছাড়া বিশ্বের আরও বহু উন্নত দেশেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আশানুরূপ নয়।
বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে ২০৬৫ সালে জাপানের জনসংখ্যা ৮ কোটি ৮ লাখে নেমে আসবে, যা হবে ৪৫ বছরের মধ্যে ৩০ শতাংশ অবনতি। জাপানের এই অবস্থার অন্যতম কারণ দেশটির খুবই নিম্ন প্রজনন হার। ১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে জাপানের প্রজনন হার কমতে শুরু করে। ২০০০-এর দশকে এসে মোট প্রজনন হার ছিল নারীপ্রতি ১ দশমিক ৩ জন সন্তান। ২০০৫ সালে এসে এটি আরও কমে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২৬। ২০১০ এর দশকে কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। তখন নারীপ্রতি প্রজনন হার ছিল ১ দশমিক ৪। জাপানে বিবাহবহির্ভূত সন্তান জন্মদানের হারও কম, ২ শতাংশ। দেশটিতে প্রজনন হার কমে যাওয়ার প্রধান কারণ নারীদের বিয়েবিমুখতা।
একজন নারীর ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সকে তার সন্তান জন্মদানের সেরা সময় বিবেচনা করা হয়। ১৯৭০ এর দশক থেকেই দেশটিতে এই বয়সী নারীদের অবিবাহিত থাকার যে হার, সেটি প্রায় অপরিবর্তিতই ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী অবিবাহিত নারীর হার ছিল ২১ শতাংশ, যেটি ২০২০ সালে এসে হয়েছে ৬৬ শতাংশ। ৩০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ৩৯ শতাংশ। তরুণ জাপানি নারীরা দিনদিন আরও বিয়ে এবং সন্তানবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের সামনে এখন আরও ভালো অর্থনৈতিক সুযোগ উন্মোচিত হচ্ছে। নারীদের মধ্যে এখন ৪ বছরের কলেজ ডিগ্রি গ্রহণের প্রবণতাও আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ এর দশক থেকে এর উত্থানের শুরু, বর্তমানে যেটি ৫১ শতাংশে পৌঁছেছে।
নারীদের বেকারত্বও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সত্তরের দশকে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৪৫ শতাংশ, ২০২০ সালে এসে এটি উন্নীত হয়েছে ৮৭ শতাংশে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের দিক থেকে জাপান বিশ্বের অন্যতম সফল দেশ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও জাপানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার বেশি। বিয়ের হার কমে যাওয়ায় গৃহকর্মে যে লৈঙ্গিক পার্থক্য, সেখানেও প্রভাব পড়ছে। জাপানে ঐতিহাসিকভাবে নারীরা গৃহকর্ম ও সন্তান লালনপালনের কাজ করে আসছে। গৃহকর্মে এখনো পুরুষের অংশগ্রহণ কম এবং এক্ষেত্রে নারীর উপর চাপ এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। একজন জাপানি পিতা দৈনিক গড়ে ৪১ মিনিট গৃহকর্মে সময় দেন, যুক্তরাষ্ট্রে যেটি প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
নারীরা এখন দেখতে পাচ্ছে তাদের সামনে নতুন নতুন অর্থনৈতিক দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে এবং বিয়ে করলে গৃহকর্মের দিকেও তাদের বেশি খেয়াল রাখতে হচ্ছে। ফলে কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পান না তারা। এটি তাদের মধ্যে বিয়ে নিয়ে বিরূপ ধারণার জন্ম দিচ্ছে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খাতে নিম্ন জনসংখ্যার হারের ক্ষতিকর প্রভাবের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে জাপান সরকার ১৯৯০ এর দশকে বেশ কিছু প্রোগ্রাম চালু করে। প্রাথমিকভাবে এর লক্ষ্য ছিল শিশুযত্নের বিভিন্ন দিক আরও সহজলভ্য করা এবং ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের মধ্যে ভারসাম্য আনা।
সরকার পরবর্তীতে আরও দীর্ঘস্থায়ী উদ্যোগও নেয় যেখানে শিশুর জন্ম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১০ এর দশকে এসে জাপান সরকারের সব ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্তে প্রজনন হার বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা শুরু হয়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নানারকম নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণের পরও দেশটি প্রজনন হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো সফলতা পায়নি।
জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে পড়তির দিকে থাকা প্রজনন হারের একটি দেশকে উচ্চ প্রজননশীল করার কতটা দুঃসাধ্য। জাপানের জনসংখ্যার এমন নাটকীয় পতনের সমাধান হিসেবে আইন শিথিল করে বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী দিয়ে ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারত, কিন্তু দেশটিতে এমন পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। জাপান পৃথিবীর অন্যতম রক্ষণশীল দেশ এবং দেশটির মানুষ অতটা অভিবাসীবান্ধব নয়।
তার মানে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাড়ানো ছাড়া জাপানের সামনে আর কোনো পথ নেই।
তাহলে সমাধান কী হতে পারে? জাপান সরকারকে এমন আরও উদ্যোগ নিতে হবে যাতে নারীরা সন্তান নিতে সংকোচ বা দ্বিধায় না পড়ে। সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে বড় হওয়া পর্যন্ত যে খরচ, সেটিও আরও কীভাবে কমানো যেতে পারে, সরকার সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে পারে।
দেশের কর্মক্ষেত্র পরিবারবান্ধব হতে হবে। ঘরে বাইরে সর্বত্র পুরুষ ও নারীর মধ্যে দায়িত্ব ও কাজের দিক থেকে পার্থক্য কমাতে হবে। পারিবারিক জীবনের মান উন্নয়নের দিকেও জাপান সরকারকে নজর দিতে হবে।
Comments