থিওডোর রুজভেল্টের হাত ধরে যেভাবে বদলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি
থিওডোর রুজভেল্ট যখন ১৯০১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন, তখনই তিনি বুঝেছিলেন কয়েক বছর আগেও আন্তর্জাতিক মানচিত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন ছিল, বর্তমানে সেটি অনেকখানিই বদলে গেছে। ভবিষ্যৎ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কেমন হবে, সেটি সম্ভবত রুজভেল্টই প্রথম ভালোভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রুজভেল্ট তার পররাষ্ট্রনীতি এমনভাবে সাজিয়েছিলেন, যাতে পরবর্তী বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের অধিপত্য আরও প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশাল আধিপত্য ও প্রভাব, তার জনক মনে করা হয় রুজভেল্টকেই। তার আমলেই যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক শক্তি থেকে প্রধান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং তার গৃহীত কিছু নীতির ফলে সেই অধিপত্য ১০০ বছর পরও বহাল আছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম বৃহৎ আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৮৯৮ সালে স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সামনে নতুন নতুন দ্বার উন্মুক্ত হতে থাকে। গুয়াম, পুয়োর্তো রিকো, হাওয়াই ও ফিলিপিন্স যুক্তরাষ্ট্র দখল করে নেয়। কিউবার রক্ষক হিসেবেও নিজেকে জাহির করে যুক্তরাষ্ট্র।
নিজের মূল ভূখণ্ড থেকে বহু দূরের এসব অঞ্চল দখল করার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হতে শুরু করে। রুজভেল্ট মনে করতে থাকেন বিশ্বে মার্কিন প্রভাব, নীতি ও আদর্শ প্রচারের এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। ইউরোপীয় শাসকরা এক সময় নতুন নতুন ভূমি দখল করে যা করতো, রুজভেল্ট সেটাই করতে শুরু করেন। তিনিও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, নীতি ও আদর্শে নাক গলানো শুরু করলেন।
লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব রিহ্যাম্পটন এর ইতিহাসের অধ্যাপক এবং 'থিওডোর রুজভেল্ট'স ঘোস্ট: দ্য হিস্টোরি অ্যান্ড মেমোরি অব এন আমেরিকান আইকন' বইয়ের লেখক মাইকেল প্যাট্রিক ক্যালিনান বলেন, ''তিনি (রুজভেল্ট) মনে করতেন 'উন্নত জাতিগুলোর' দায়িত্ব 'অনুন্নত' জাতিগুলোকে তাদের কাতারে উন্নীত করা।'
এর পাশাপাশি রুজভেল্ট মনে করতেন যুক্তরাষ্ট্র যদি এখনই বৈশ্বিক বিষয়ে নিজের প্রভাব খাটাতে না পারে, তাহলে দেশটি ধীরে ধীরে তার বৈশ্বিক প্রভাব হারাতে থাকবে। সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়াতে ও সেটি ধরে রাখতে দেশটির এই ২৬তম প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখা শুরু করলেন এবং অন্যান্য দেশগুলোকে এই বলে সতর্ক করতে থাকলেন যে তারা বিশাল নৌবাহিনী তৈরি করছে। এই বড়ভাই ও শাসকসুলভ আচরণকে রুজভেল্ট ব্যাখ্যা করেছেন 'স্পিক সফটলি অ্যান্ড ক্যারি এ বিগ স্টিক', অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র নরম ভাষায় কথা বলবে, কিন্তু প্রয়োজনে শক্তি ব্যবহার করবে। এটাই ছিল রুজভেল্টের বিদেশ নীতির প্রধান মন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র এখনো এই মন্ত্র মেনেই বিদেশ নীতি পরিচালনা করে।
শুধু হুমকি-ধামকি না দিয়ে রুজভেল্ট এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার ফলে তার বিদেশ নীতি (বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করা) অনেকখানি সফল হয়েছিল। রুজভেল্টের নেওয়া এমন ৪টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে-
পানামা খাল তৈরির উদ্যোগ
পুরো দক্ষিণ আমেরিকা না ঘুরে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংক্ষিপ্ত নৌপথ চালুর লক্ষ্যে পানামায় একটি খাল খননের উদ্যোগ নেন রুজভেল্ট, যেটি এখন পানামা খাল নামে পরিচিত। খালনি খননে অনেকের তীব্র আপত্তি ও মহামারিতে বহু খননশ্রমিকের মৃত্যু সত্বেও রুজভেল্ট এই প্রকল্পে অটল ছিলেন। ১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্ট্রাকশন কোম্পানি খাল খননের কাজ শুরু করে এবং রুজভেল্টের শাসনামল শেষ হওয়ার ৫ বছর পর ১৯১৪ সালে এই খালের খননকাজ শেষ হয়।
রুজভেল্ট যখন খাল খননের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করতে চাইলেন, তখন এই অঞ্চলটি ছিল কলম্বিয়ার অধীনে। রুজভেল্ট সরকার কলম্বিয়া সরকারের সঙ্গে খাল খননের জন্য ভূমি অধিগ্রহনের ব্যাপারে সমঝোতাও করতে চেয়েছিল কিন্তু কলম্বিয়া সরকার সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
কলম্বিয়া সরকার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রুজভেল্ট প্রশাসন স্বাধীনচেতা পানামাবাসীর পক্ষ অবলম্বন করতে শুরু করে। এরা কলম্বিয়া থেকে পানামার স্বাধীনতার জন্য তখন সংগ্রাম করছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ১৯০৩ সালে কলম্বিয়া থেকে স্বাধীনতার পর রুজভেল্ট প্রশাসন পানামার সঙ্গে চুক্তি করে খালের জন্য ভূমি লিজ নেয়। ১৯০৬ সালে রুজভেল্ট নিজে খননকাজ দেখতে পানামা যান। রুজভেল্টই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি নিজের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড ছেড়ে অন্যত্র গিয়েছিলেন। সেই ভ্রমনে পানামা খালের খননকাজের তোলা তার ছবিটি এখনো ইতিহাসের অংশ।
কলম্বিয়ার সরকারের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় পানামার পক্ষাবলম্বন করা ছিল তখনকার বাস্তবতায় এক ঐতিহাসিক ও বিতর্কিত পদক্ষেপ। কারণ এটি করে মার্কিন প্রশাসন সরাসরি অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিল। তবে সফলভাবে এই পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার পর দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন রুজভেল্ট।
মনরো মতবাদকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া
১৮২৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো একটি মতবাদ দেন, ইউরোপীয় দেশগুলো আমেরিকানদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। এটি 'মনরো ডকট্রিন' নামে পরিচিত। মনরো বলেছিলেন, পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা ও তাদেরকে শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের। এখানে ইউরোপীয়রা কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
রুজভেল্ট মনরোর মতবাদের সঙ্গে আরেকটু যোগ করেন। তিনি বলেন, 'পুনরায় ইউরোপীয় শাসকদের উপনিবেশ হওয়ার হাত থেকে আমেরিকান অঞ্চলের দেশগুলোকে রক্ষার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের এবং এর জন্য প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগেও যুক্তরাষ্ট্র পিছ পা হবে না। ভেনেজুয়েলার তৎকালীন করুণ অবস্থা রুজভেল্টকে এমন কঠোর অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। উপনিবেশিক শক্তি ভেনেজুয়েলার কাছে ঋণ হিসেবে যে অর্থ দাবি করেছিল, সেটি পরিশোধের ক্ষমতা তখন দেশটির ছিল না। ভেনেজুয়েলানরা তখন ভয় পাচ্ছিলেন যে এই ঋণের কথা বলে উপনিবেশিক শক্তি দেশটিকে আবারও দখল করে নিতে পারে।
রুজভেল্ট বুঝতে পেরেছিলেন উপনিবেশিক শক্তিগুলো আমেরিকা অঞ্চল থেকে তাদের লক্ষ্য সরিয়ে নিচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্রিটেনের নজর পূর্ব আফ্রিকা এবং ভারতের দিকে, ফ্রান্সের নজর পশ্চিম আফ্রিকার দিকে আর জাপানের নজর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে। এই সমীকরণ বুঝতে পেরে রুজভেল্ট আমেরিকা অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
রুশ-জাপানিজ যুদ্ধ শেষ করতে আলোচনার উদ্যোগ
নিজ শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড ছাড়া প্রথম প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি রুজভেল্ট প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯০৪-১৯০৫ সাল পর্যন্ত চলা রুশ-জাপানিজ যুদ্ধে শান্তি চুক্তি করতে মধ্যস্থতা করায় তিনি এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।
যুদ্ধরত ২ পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়ে রুজভেল্ট যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন পর্যায়ে উপনীত করতে পেরেছিলেন। রুজভেল্টের বিদেশ নীতির যে মূলমন্ত্র, বড়ভাইসুলভ আচরণ, সেটি এই সফল মধ্যস্থতার উদ্যোগে আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রুজভেল্টের আগে অন্যান্য মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও ভূমিকাকে আঞ্চলিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু রুজভেল্ট প্রথম থেকেই ভাবতেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হবে বিশ্বব্যাপী এবং জাপানের মতো অত দূরেও যদি আমেরিকার স্বার্থ থাকে, সেখানেও যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব খাটাতে পারে।
এই মধ্যস্থতা ছিল বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিদেশ নীতির আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত।
'থিওডোর রুজভেল্ট: এ স্ট্রিনিউয়াস লাইফ' বইয়ের লেখক ক্যাথলিন ডাল্টন বলেন, '১৯০০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়। তাই ইউরোপে কোনো নীতি-নির্ধারনী আলোচনায় অনুপস্থিত থাকাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল অবমাননাকর। রুজভেল্টই প্রথম এসব 'অবমাননা' থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে 'সম্মানজনক' অবস্থানে নিয়ে আসেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে তার কৌশলগত কূটনীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্মানজনক বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হয়।
রুশো-জাপানিজ যুদ্ধ শেষ করতে সফল মধ্যস্থতার পর রুজভেল্ট মরোক্কো নিয়ে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যকার বিবাদও মীমাংসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জেন্টেলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট
১৮৭৫ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না, অর্থাৎ, দেশটিতে বৈধ বা অবৈধ অভিসান বলতে কিছু ছিল না। যার যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা, সে তখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারতো। ১৮৭৫ সালে 'পেইজ অ্যাক্ট' এবং ১৮৮২ সালে 'চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট' এর ফলে এই রীতি অনেখানিই পরিবর্তন হয়ে যায়। এই দুটি আইনের ফলে প্রায় সব চীনা নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
রুজভেল্ট এসে অভিবাসন আইন আরও কঠোর করেন। যেসব আমেরিকান নারী নন-আমেরিকানকে বিয়ে করবেন, তাদের নাগরিকত্বও বাতিলের নিয়ম রাখা হয় রুজভেল্টের অভিবাসন নীতিতে।
তবে অভিবাসন সম্পর্কিত যে সিদ্ধান্তের কারণে রুজভেল্ট প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, সেটি আদতে কোনো আইন ছিল না। জাপানি অভিবাসীরা তখন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা প্রচুর নিগৃহের শিকার হতো। এ নিয়ে জাপান ছিল খুবই ক্ষুদ্ধ। রুজভেল্ট তখন জাপান সরকারের সঙ্গে একটি মধ্যস্থতা করেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জাপানি অভিবাসীদের সুরক্ষা দেবন, বিনিময়ে জাপান কোনো শ্রমিককে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হতে উৎসাহ দেবে না।
জাপান সরকারের সঙ্গে রুজভেল্টের এই মধ্যস্থতা 'দ্য জেন্টলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট' নামে পরিচিত। এই চুক্তির ফলে জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কও অক্ষুন্ন থাকে আবার একই সঙ্গে পূর্ব এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনও বন্ধ হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে এশিয়ার মানুষদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি আরও কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকে। ১৯১৭-১৯২৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন অভিবাসন নীতির কারণে এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন একপ্রকার বন্ধই ছিল। অন্তত ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই কঠোরতা কম-বেশি বলবৎ ছিল।
Comments