ফেনীর ‘রসগোল্লা’ যাচ্ছে সুদূর আফ্রিকাতেও

খন্ডলের মিষ্টি
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার ছোট্ট বাজার খন্ডল হাইয়ের ‘রসগোল্লা’। ছবি: স্টার

'রসের গোলক, এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়/ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়।'- বিখ্যাত রম্যগল্প 'রসগোল্লা'য় এভাবেই বাঙালির জীবনযাপনের সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্যতম অনুষঙ্গ রসগোল্লার গুণকীর্তন করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী।

ওই গল্পের প্রধান চরিত্র ঝান্ডুদা রসগোল্লার ভ্যাকুয়াম টিন খোলার শোকে বিদেশ–বিভূঁইয়ে চুঙ্গিঘরের কর্মকর্তার মুখে রসগোল্লা 'থেবড়ে' দিতেও পিছপা হননি।

রসগোল্লা এমনই এক মিষ্টি, যার স্বাদের মাধুর্য বাংলা মুলুকের বাইরে সাত সাগর তের নদী পেরিয়েছে অনেক আগেই। আর এই উপাদেয় মিষ্টির উদ্ভব আসলে কোথা থেকে—তা নিয়ে ধন্দ কিংবা বিতর্ক থাকলেও ফেনীর খন্ডলের রসগোল্লার স্বাদ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

তৈরির প্রক্রিয়া ও গুণগত দিক থেকে 'রসগোল্লা' হলেও ফেনীর বিখ্যাত এই মিষ্টান্ন সর্বমহলে 'খন্ডলের মিষ্টি' নামে পরিচিত। প্রচলিত রসগোল্লার মতোই এর স্বাদ ও সুনাম বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছে।

খন্ডলের মিষ্টি
খন্ডল হাইয়ের ‘রসগোল্লা’ খন্ডলের মিষ্টি হিসেবে সুপরিচিত। ছবি: স্টার

ফেনীর নিভৃত এক পল্লীতে উৎপত্তি হওয়া এই মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। বাদ যায়নি আফ্রিকাও।

ফেনী থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে পরশুরাম উপজেলার ছোট্ট এক বাজারের নাম খন্ডল হাই। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে এই বাজারের নামেই নামকরণ হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির।

স্থানীয় ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুস্বাদু এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করেছিলেন যোগল চন্দ্র দাস। ষাটের দশকের শেষভাগে ভাগ্যান্বেষণে বাড়ি ছাড়েন তিনি। ভায়রা ভাইয়ের ডাকে বসতি গড়েন পরশুরামের খন্ডল হাই বাজারের পার্শ্ববর্তী বণিক পাড়ায়। থাকার সংস্থান হলেও তার কাজের সংস্থান ছিল না।

শুরুতে খন্ডল হাই বাজারে ছোট্ট চায়ের দোকান খুলেন তিনি। দোকানে মূলত নাস্তার সামগ্রীই বিক্রি হতো। একপর্যায়ে বাড়তি উপার্জনের আশায় নাস্তা খেতে আসা ক্রেতাদের জন্য কিছু মিষ্টিও তৈরি করতে থাকেন তিনি।

দোকানটির মিষ্টি স্থানীয়রা পছন্দ করায় মিষ্টি তৈরির পরিমাণ কিছুটা বাড়ান তিনি।

মোট ৫২ ধরনের মিষ্টি বানাতে পারতেন যোগল। তার মিষ্টি বানানোর পারদর্শিতার কথা জানতে পেরে তার কাছে মিষ্টি বানানো শিখতে কিছু সাগরেদও জুটে যায়।

এরমধ্যে যোগল দাসের দোকানের স্পঞ্জের মিষ্টির খ্যাতি আশপাশের এলাকা ছড়িয়ে পড়ে। এক বছরের মাথায় শারীরিক অসুস্থতার কারণে যোগল চন্দ্র দাস দোকান বন্ধ করে পার্শ্ববর্তী ফুলগাজীতে চলে গেলেও তার সাগরেদরাই ধরে রাখেন খন্ডলের মিষ্টির ঐতিহ্য।

খন্ডলের মিষ্টি
খন্ডলের মিষ্টি তৈরির আগে প্রস্তুত মিষ্টির মন্ড। ছবি: স্টার

যোগলের সাগরেদদের মধ্যে অন্যতম কবির আহমদ পাটোয়ারী। মূলত তার হাত ধরেই খন্ডলের এই সুস্বাদু মিষ্টির সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিস্তৃত এলাকায়। বছর দুয়েক আগে মারা যান কবির আহমদ। বর্তমানে তার সন্তানরাই ধরে রেখেছেন খন্ডলের মিষ্টির ঐতিহ্যের আভিজাত্য।

খন্ডল হাই বাজারের পথে

খন্ডলের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির গল্প শুনতে এক সকালে হাজির হই পরশুরাম উপজেলার খন্ডল হাই বাজারে। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৯টার কাঁটা পেরিয়েছে। পথে দেখা মেলে—কলসভরা দুধ নিয়ে গৃহস্থরা খন্ডল হাই বাজারের দিকে যাচ্ছেন।

আগেই জানা ছিল যে ফেনীর নানা প্রান্তে অসংখ্য 'খন্ডলের ১ নম্বর মিষ্টি'র দোকান ছড়িয়ে থাকলেও মূলত এই বাজারের ২টি দোকানেই তৈরি হয় খন্ডলের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। দোকান ২টির একটি কবির আহম্মদ পাটোয়ারীর 'খন্ডলের পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা' ও অন্যটি দেলোয়ার হোসেনের 'খন্ডলের আসল মিষ্টি মেলা'।

শুরুতে আমরা 'খন্ডলের পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা' দোকানে যাই। সেখানে ঢুকতেই এগিয়ে আসেন দোকানের এখনকার স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ বেলাল। আমাদের বসতে বললেন। কিন্তু আমরা তো বসতে আসিনি। এসেছি মিষ্টি তৈরি দেখতে। শুনে হাসলেন তিনি। বললেন দুধ আসছে এখন। ততক্ষণে দোকানে ক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে।

বেলাল আমাদের নিয়ে যান বাজারের উল্টো পাশে থাকা টিনের ঘরে। সেই ঘরের বাইরে তখন আশপাশের গ্রাম থেকে কলসি, প্লাস্টিকের ড্রাম, বোতল ও হাঁড়িতে করে দুধ আসছিল।

খন্ডলের মিষ্টি
তৈরি হচ্ছে খন্ডলের মিষ্টি। ছবি: স্টার

খন্ডলের মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া

ওই টিনের ঘরে দেখা গেল, প্রথমে সুতি কাপড়ে কাঁচা দুধ ছেঁকে নেওয়া হলো। এরপর চুলায় চাপানো হয় ১৭ কেজি দুধ। আধঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর চুলা থেকে নামানো হয় সেই দুধ। তারপর উষ্ণ দুধে টক পানি ও কিছুটা বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা পানি মিশিয়ে দুধ ফেটানো হলো। এরপর সেই দুধ থেকে সুতি কাপড়ের মাধ্যমে ছানা আলাদা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ছানার পানি পুরোপুরি শুকিয়ে নিয়ে ১৭ কেজি দুধ থেকে পাওয়া গেল ২ কেজির মতো ছানা।

এরপর শুকানো ছানা নেওয়া হলো পাশের টেবিলে। শুরু হয় মণ্ড তৈরির প্রক্রিয়া। প্রথমে হাত দিয়ে পুরো ছানা দলা করে ছানার মধ্যে মেশানো হয় ২০ গ্রামের মতো ময়দা। ময়দা দেওয়ার অন্যতম কারণ পরবর্তীতে মিষ্টির মণ্ড যেন ভেঙে না যায়।

মিষ্টির সিরা তৈরির ধাপ

প্রথমে ৬ লিটার পানি হালকা জ্বাল করে তাতে ৫ কেজি চিনি মেশানো হয়। উচ্চ আঁচে ১৫ মিনিটের মতো জ্বাল হওয়ার পর তা নামিয়ে সেঁকে নেওয়া হয়।

এরপর ফের চুলায় সিরা উঠিয়ে তাতে মিষ্টির মণ্ডগুলো ছেড়ে দিয়ে আধঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় খন্ডলের ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু মিষ্টি। খন্ডলের মিষ্টির অন্যতম বিশেষত্ব হল বাংলাদেশের অন্যান্য প্রায় সব মিষ্টি ঠান্ডা অর্থাৎ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খাওয়া হলেও খন্ডলের মিষ্টি খাওয়া হয় গরম এবং ঠাণ্ডা উভয় অবস্থাতেই।

যেভাবে জনপ্রিয়তা পায় খন্ডলের মিষ্টি

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বছরে 'পাটোয়ারী মিষ্টি মেলা' দোকানটি শুরু করেছিলেন কবির আহমদ পাটোয়ারী। ১৯৮৩-৮৪ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে মিয়াধন বিজয়ী হওয়ার পর আশপাশের ইউনিয়ন ও থানাজুড়ে মিষ্টি বিতরণ করেন। এরপর ছড়িয়ে পড়ে খন্ডলের মিষ্টির সুখ্যাতি।

আবার ১৯৯১ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় পরশুরাম ও ফুলগাজীতে আসেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। সেসময় নেতাকর্মীরা তার জন্য উপহার হিসেবে খন্ডলের মিষ্টি নিয়ে আসেন। মিষ্টির সুনাম শুনে ও চেখে দেখে ভীষণ মুগ্ধ হন তিনি। ঢাকায় ফেরার পথে গাড়িভর্তি করে মিষ্টি নিয়ে আসেন।

স্থানীয়রা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এরপর খালেদা জিয়া যতবারই ফেনীতে গিয়েছেন ততবারই তিনি খন্ডলের মিষ্টি খুঁজেছেন। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে খন্ডলের মিষ্টির সুনাম। পরে স্থানীয় প্রবাসীদের মাধ্যমে খন্ডলের মিষ্টি ছড়িয়ে যায় অন্য দেশেও।

দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা ফেনীর প্রবাসীরাও প্রবাসে থাকা স্বজন ও বন্ধুদের জন্য খন্ডলের মিষ্টি নিয়ে যান।

এই অঞ্চলের মানুষের কাছে খন্ডলের মিষ্টি ছাড়া কোনো ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক উৎসব অকল্পনীয় বলে বিবেচিত হয়। বিয়ে বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে খন্ডলের মিষ্টি থাকা চাই-ই।

পাটোয়ারী মিষ্টি মেলার স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ বেলাল ডেইলি স্টারকে বললেন, 'গত এক সপ্তাহে এই দোকান থেকে কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় প্রায় ৪০ কেজি খন্ডলের মিষ্টি নিয়ে গেছেন প্রবাসীরা।

খন্ডলের মিষ্টির উদ্ভব যার হাতে সেই যোগেন চন্দ্র দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খন্ডলের মিষ্টির প্রধান ও একমাত্র উপকরণ হলো খাঁটি দুধের ছানা। এখানে গোপন ফর্মুলা নেই। হ্যাঁ- মণ্ড যাতে ফেটে না যায় সেজন্য কিছুটা ময়দা মেশানো হয়। বাকিটা হাতের গুণ।'

খন্ডলের মিষ্টি খেতে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কুমিল্লাসহ দূর-দুরান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসেন শত শত মানুষ।

তেমনই একজন কুমিল্লার লাকসামের মাইনউদ্দিন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই মিষ্টির সুনাম অনেক শুনেছি। আজই প্রথম খেতে এলাম। খেতে ভীষণ ভালো লেগেছে।'

নোয়াখালীর কবিরহাট থেকে আগত জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাঝেমধ্যেই খন্ডলের মিষ্টি খেতে আসা হয়। যাওয়ার সময়ে পরিবারের সদস্যদের জন্যও কিনে নিয়ে যাই।'

এই মিষ্টির ভীষণ চাহিদা ও খ্যাতি সত্ত্বেও প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মিষ্টি তৈরি করেন না মোহাম্মদ বেলাল। বললেন, 'দিনে ১৫০ কেজির মতো মিষ্টি তৈরি করি। চাহিদা বেশি হলেও আমরা গুণমানে বিশ্বাসী। মিষ্টির মান-ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেই আমরা সন্তুষ্ট।'

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

5h ago