নরম খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস যেভাবে ‘এফ’ ও ‘ভি’ ধ্বনির উচ্চারণ সহজ করেছে
![একজন প্রাচীন নারীর চোয়ালে (বামে) ওভারবাইট দেখা না গেলেও ব্রোঞ্জ যুগের একজন পুরুষের চোয়ালে (ডানে) ওভারবাইট দেখা যাচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত একজন প্রাচীন নারীর চোয়ালে (বামে) ওভারবাইট দেখা না গেলেও ব্রোঞ্জ যুগের একজন পুরুষের চোয়ালে (ডানে) ওভারবাইট দেখা যাচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/02/21/ancient.jpg?itok=en3BWXMF×tamp=1676973762)
বিশ্বব্যাপী মানুষের ব্যবহৃত ভাষাগুলোতে অন্তত ২ হাজার আলাদা আলাদা ধ্বনি আছে। এর মধ্যে কিছু ধ্বনি বেশি ব্যবহৃত হয়, আবার কিছু কম।
ভাষাগত তারতম্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কিছু ধ্বনির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি।
কিন্তু কেনো কিছু কিছু ধ্বনি প্রায় সব ভাষাতেই পাওয়া যায়? দীর্ঘ ৫ বছরের এক যুগান্তকারী গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা এ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন।
২০১৯ সালের মার্চে সায়েন্স ম্যাগাজিনে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
প্রায় ৩০ বছর আগে ভাষাবিদ চার্লস হকেট ধারণা দিয়েছিলেন, যেসব অঞ্চলের মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি 'নরম খাবার' গ্রহণ করতো, সেসব অঞ্চলে 'এফ' এবং 'ভি' এর মতো ল্যাবিওডেন্টাল ধ্বনিগুলোর প্রচলন বেশি। ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের গবেষক ড্যামিয়েন ব্লসির নেতৃত্বে একদল গবেষক ঠিক এ বিষয়টিরই প্রমাণ পেয়েছেন। ল্যাবিও মানে হচ্ছে 'ঠোঁট' আর ডেন্টাল মানে হচ্ছে 'দাঁত'। যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় নিচের ঠোঁটকে ওপরের মাড়ির দাঁতের সঙ্গে স্পর্শ করাতে হয়, সেগুলোকেই মূলত ল্যাবিওডেন্টাল ধ্বনি বলা হয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তুলনামূলকভাবে নরম খাবার খাওয়ার ফলে মানুষের চোয়াল ওভারবাইট কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। সাধারণত আমাদের দাঁতের ওপরের পাটি নিচের পাটির চেয়ে একটু সামনের দিকে বের হয়ে থাকে, এই কাঠামোকেই ওভারবাইট বলে। চোয়ালের এমন কাঠামোর কারণেই ল্যাবিওডেন্টাল ধ্বনির উচ্চারণ আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ।
গবেষকদের পর্যবেক্ষণ মতে, কৃষি খাতের অগ্রযাত্রার কারণেই মূলত এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। নিওলিথিক সময়ের আগে খাবার ছিল অত্যন্ত শক্ত এবং তা অনেক সময় নিয়ে, ভালো করে চিবিয়ে খেতে হতো। কিন্তু কৃষির উন্নয়নের ফলে আলুর মতো তুলনামূলকভাবে নরম খাবার উৎপাদন সম্ভব হয়েছ, যেগুলো খাওয়ার সময় দাঁত ও চোয়ালের ওপর অতটা চাপ পড়ে না। যেহেতু চোয়ালের কাজ অনেকটাই কমে গিয়েছিল, তাই চোয়ালের হাড়গুলোও আর বড় হতো না। এজন্য প্রাচীনকালের মানুষের তুলনায় বর্তমান মানুষের চোয়াল তুলনামূলকভাবে ছোট।
ভাষার রূপান্তরের ওপর গবেষণা করেও দেখা গেছে যে নিওলিথিক সময়ের পর থেকে বিশ্বের ভাষাগুলোতে চমকপ্রদ পরিবর্তন হয়েছে। 'এফ' এবং 'ভি'র মতো ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নরম খাবারের প্রভাবেই যে এটি হয়েছে, তার প্রমাণ হচ্ছে এখনো প্রাচীনকালের জীবনযাপনে অভ্যস্ত কিছু মানুষের ভাষাতে ল্যাবিওডেন্টাল ধ্বনির ব্যবহার অনেক কম।
নানা কারণে এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বিশ্বাস করেন ৩ লাখ বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সদের বিকাশের সময় থেকেই মানুষের ভাষার সবগুলো ধ্বনি উপস্থিত ছিল, যা বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের ফলে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষকদলের একজন সদস্য স্টিভ মোরান বলেন, 'আমাদের ব্যবহৃত ধ্বনিগুলো সবসময় অপরিবর্তিত ছিল, এমনটা বলা যাবে না। বরং বর্তমানে আমরা যে ধ্বনি ব্যবহার করি, সেগুলো বায়োলজিক্যাল এবং সাংস্কৃতিক জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফলে উদ্ভব হয়েছে।'
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের শিক্ষক শন রবার্টস মনে করেন, ভাষার পরিবর্তন সম্পর্কিত জ্ঞানের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা'।
'প্রথমবারের মতো সকল তথ্যবিশ্লেষণ করে দেখতে পাচ্ছি, আমাদের কথা বলার ভঙ্গির সঙ্গে আমাদের জীবনযাপন প্রক্রিয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একজন ভাষাবিদের জন্য এটি খুবই উত্তেজনাকর আবিষ্কার', যোগ করেন তিনি।
এরপর রেস্তোরাঁয় 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' অর্ডার করার সময় প্রাচীন যুগের কৃষকদের অবদানের কথা ভুলে যাবেন না!
কারণ তাদের অবদান ছাড়া এখন হয়তো আমরা ফ্রেঞ্চ এর এফ উচ্চারণই করতে পারতাম না। মূলত সেসব কৃষকদের জন্যই আমরা এখন এফ ও ভি যুক্ত হাজার হাজার শব্দ আবিষ্কার ও উচ্চারণ করতে পারছি। বর্তমানে প্রচলিত অর্ধেকেরও বেশি ভাষায় এ ২ ধ্বনির ব্যবহার রয়েছে।
তথ্যসূত্র: সায়েন্সডটওআরজি
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল
Comments