গণঅভ্যুত্থানে চবি ছাত্র হত্যা: মামলার বাদীকে নিয়ে নানা অভিযোগ, বিচার নিয়ে সংশয়
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। ওই ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ ৭০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে, যিনি এই মামলার বাদী তার নিজের বিরুদ্ধেই মাদক, মারামারি, এবং পরিবেশ আইনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কমপক্ষে পাঁচটি মামলা রয়েছে। হৃদয়ের বাবা নিজেই এখন ছেলের হত্যার বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয়ে আছেন।
অভিযোগ উঠেছে হৃদয় হত্যা মামলায় অনেককেই আসামি করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়েরও অভিযোগ উঠেছে বাদীর বিরুদ্ধে। মামলায় চট্টগ্রামের চার সাংবাদিক এবং সাবেক দুই ওসিকে আসামি করা হয়েছে। এ দুই ওসি আন্দোলনের সময় ঢাকা ও মনোহরদী থানায় ওসির দায়িত্বে ছিলেন।
হৃদয় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামের রতন চন্দ্র তরুয়া ও অর্চনা রানীর ছেলে। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছোট ছিলেন। পড়তেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষে। মির্জাগঞ্জে গ্রামের বাড়ি হলেও তারা দীর্ঘদিন ধরে পটুয়াখালী শহরের মুন্সেফপাড়া এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। হৃদয় থাকতেন ক্যাম্পাসের শাহজালাল হলে।
গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় টিউশনি থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মোড়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন হৃদয়। তাকে প্রথমে নগরীর পার্কভিউ হাসপাতাল এবং পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই ভোরে মারা যান তিনি।
এই ঘটনায় গত ২০ সেপ্টেম্বর চান্দগাঁও থানার হত্যা মামলা করেন আজিজুল হক। মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাকে। আসামিদের মধ্যে আরও আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম, দিলীপ কুমার আগরওয়াল, খাগড়াছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সিটি করপোরেশনের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি নুরে আলম মিনা, সিএমপির সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, চট্টগ্রাম জেলার সাবেক পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ, খাগড়াছড়ির সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংশেফ্রু।
মামলায় ৩৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে আবুল কাশেম ভূঁইয়াকে, যিনি ঘটনার সময় নরসিংদী মডেল থানার ওসি ছিলেন। আর ৪০ নম্বর আসামি করা হয়েছে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ মহসিনকে, যিনি ঘটনার সময় ঢাকার তেজগাঁও থানার ওসি হিসাবে দায়িত্বরত ছিলেন।
এছাড়া মামলার ১৪৮ থেকে ১৫১ নম্বর পর্যন্ত আসামি করা হয়েছে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, সময় টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান কমল দে, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক ও একুশে টিভির সাবেক আবাসিক সম্পাদক রফিুকুল বাহারকে।
আজিজুল যেভাবে মামলার বাদী হলেন
মামলার বাদী আজিজুল পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানা, পাঁচলাইশ থানা এবং কক্সবাজার সদর থানায় পাঁচটির অধিক মামলায় রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তিনি হৃদয়ের বন্ধু পরিচয় দিয়ে থানায় এজাহার দিয়েছেন। আন্দোলনে অংশ না নিলেও, ১৮ জুলাই ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে তিনি মামলায় দাবি করেছেন। তবে হৃদয়ের সহপাঠীরা আজিজুলকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন।
হৃদয়ের বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'মামলার করার বিষয়ে আমার ছেলের বন্ধু পরিচয়ে আমাকে ফজলুল নামের একজন ফোন দিয়েছিল। আমি তাকে বলেছি আমি চট্টগ্রামের কাউকে চিনি না। এত দূর থেকে মামলা করাও আমার পক্ষ থেকে সম্ভব নয়। ওরা বলেছে মামলা আপনার করতে হবে না আমরাই করব। আপনি শুধু অনুমতি দেবেন।'
'তারা আমার কাছ থেকে কাগজে স্বাক্ষর করে নিয়েছে। ফজলুল আমাকে বলেছিল তার মামলা পুলিশ নিচ্ছে না। তাই আরেকজনকে দিয়ে মামলা করানো হচ্ছে। আমি মামলার বাদীকে চিনি না। শুধুমাত্র ছেলে হত্যার বিচারের আশায় আমি এতকিছু করেছি,' বলেন রতন।
ফজলুল নিজেকে চবি অর্থনীতি বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। আবার কাউকে কাউকে তিনি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। বাদী আজিজুল হকেরই ছোট ভাই তিনি। ফজলুল দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন তার ভাই আজিজুল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত।
তবে হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার বন্ধুরা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই বিভাগে ফজলুল নামে সেই সেশনে কোনো ছাত্র নেই বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
ফজলুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হৃদয়ের বাবাকে অনেকেই ফোন করেছেন। আমিও ফোন করেছি যেহেতু ঘটনার দিন সে আমার সঙ্গেই ছিল। সে গুলি খাওয়ার পর আমি ও তার আরেক বন্ধু তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই।'
'আমি আইন সম্পর্কে তেমন বুঝি না। তাই আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমার ভাই আমাকে বলেছেন তিনি বাদী হবেন। আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হয়েছিল। আমরা এখানে কোনো আসামি বাণিজ্য করিনি। অনেক নাম পুলিশ নিজ থেকেই দিয়েছে। আমরা আদালতে এসব নাম বাদ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি।'
তবে তিনি কোন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং তার বিভাগের চেয়ারম্যানের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মোবাইল বন্ধ করে দেন।
এই প্রতিবেদক হৃদয়ের তিন সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলেছেন যাদের কেউই আজিজুল হকে চেনেন না।
হৃদয়ের বন্ধু চবি পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'ফজলুল নিজেই ফোন করে তার ভাই আজিজুল হককে আইনজীবী হিসেবে আমাদের কাছে পরিচয় দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে মামলা থাকার কথা আমরা জানতাম না। মামলার বিষয়ে তখন তারা আমাদের বলেছিলেন, তারা এখানে টাকা আদায়ে কিংবা রাজনৈতিক কারণে কাউকে জড়াবেন না। কিন্তু এখন আমরা নানান কথা শুনছি।'
'ফজলুল নিজেকে ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিলেও সে আদৌ ছাত্র কিনা সেটা নিয়েই আমরা সন্দিহান। কারণ এই নামে আমরা ওই সেশন কিংবা তার আগে পরে সেশনে কাউকে খুঁজে পাইনি,' বলেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চবি ইতিহাস বিভাগের এক সহপাঠী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'আমরা মামলা নিয়ে নানান কথা শুনেছি। আমরা জানতাম ফজলুল নামে একজন মামলার বাদী হচ্ছেন। মামলা কীভাবে হচ্ছে কাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে আমরা কিছুই জানতাম না। হৃদয় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় আমি নিজেই এই মামলার সাক্ষী হতে আগ্রহী ছিলাম।'
বাদী আজিজুলের বক্তব্য
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'বয়সে বড় হলেও আমি হৃদয়ের বন্ধু। বয়সে বড় হলেও কি আমরা বন্ধু হতে পারি না?'
মামলা দায়ের করে আসামিদের কাছে অর্থ চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কারো কাছে অর্থ দাবি করিনি। এটা মিথ্যা। পুলিশ নিজেই মামলায় অনেকের নাম দিয়েছে।'
তার বিরুদ্ধে মামলা থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজুল বলেন 'এগুলো সব পলিটিক্যাল মামলা। ছাত্রলীগ, যুবলীগ আমাকে মামলায় ফাঁসিয়েছে। আমি অনেক মামলা থেকে খালাস পেয়েছি।'
এক পর্যায়ে তিনি এই প্রতিবেদককে বার বার বলতে থাকেন 'আপনি ছাত্রলীগ করেন তাই আমাকে ফোন করে এগুলো জিজ্ঞেস করছেন।'
সাংবাদিকদের মামলায় নাম দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ওগুলো আন্দোলনকারী ছাত্ররাই আমাকে দিয়েছে। আমি বলতে পারব না।'
পুলিশের ভাষ্য
মামলা দিয়ে আসামিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ পুলিশের কাছেও এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন চান্দগাঁও থানার একাধিক কর্মকর্তা। তবে তদন্তাধীন বিষয়ে কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।
তবে মামলায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন 'তিনি নিজেই আট-দশজন আইনজীবী থানায় এনে মামলা করে এজাহার নিয়ে গেছেন। এই অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা।'
'তার বিরুদ্ধে এখন আমরা অনেক কথা শুনছি,' বলেন তিনি।
Comments