নারায়ণগঞ্জে একাধিক তল্লাশি চৌকিতে সারাদিন যা করল পুলিশ
রাজধানী ঢাকায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জে স্থাপিত পুলিশের একাধিক তল্লাশি চৌকিতে ঢাকামুখী যাত্রীদের যানবাহন থেকে নামিয়ে মোবাইল ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য তল্লাশ করতে দেখা গেছে।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড ও সুলতানা কামাল ব্রিজের পূর্বপাশে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের তারাব এলাকায় এই চিত্র দেখা যায়।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, কাঁচপুর, মদনপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের তারাব, ভুলতা ও ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের পাগলা এলাকায় রয়েছে জেলা পুলিশের তল্লাশি চৌকি।
ঢাকায় সমাবেশকে ঘিরে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্কতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এসব তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সুলতানা কামাল সেতুর পূর্বপাশে তারাব বিশ্বরোড এলাকায় রূপগঞ্জ থানা পুলিশ একটি তল্লাশি চৌকি স্থাপন করেছে। দুপুর ১২টার দিকে এই চৌকিতে ঢাকামুখী একটি বাস থেকে দুই তরুণকে নামিয়ে দেয় পুলিশ। পরে তারা কোথা থেকে এসেছেন, কেন এবং কোথায় যাবেন তা জানতে চায় পুলিশ। একপর্যায়ে তাদের মোবাইল ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য তল্লাশ করেন তারা।
একইভাবে ঢাকামুখী বাস, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যাত্রীবাহী যানবাহন থামিয়ে তল্লাশি চালায় পুলিশ। যাত্রীদের বহন করা ব্যাগও তল্লাশ করে পুলিশ। অনেককে যানবাহন থেকে নামিয়ে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করতেও দেখা গেছে।
সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই তল্লাশি চৌকিতে নারী ও বৃদ্ধসহ অন্তত ২০ জনকে যানবাহন থেকে নামিয়ে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা গেছে।
তবে কোনো তল্লাশি চৌকিতে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি বলে জানায় পুলিশ।
দুপুর ১২টার দিকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া ওই দুই তরুণের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়। তারা নিজেদের মাদ্রাসা ছাত্র পরিচয় দেন। দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখার পর বিকেল ৩টার দিকে তাদের পুলিশ ছেড়ে দেয় বলে জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণ এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আব্দুল্লাহপুর যাওয়ার জন্য ঢাকাগামী একটি বাসে উঠি। আমাদের শিবিরকর্মী সন্দেহে বাস থেকে নামিয়ে তল্লাশি করে পুলিশ। তারপর অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে মোবাইলে গ্যালারি ও ফেসবুক ঘেঁটে দেখে। পরে চেকপোস্টের পাশে একটি মসজিদে জুমার নামাজের জন্য নিয়ে যায়। আমাদের বিরুদ্ধে কিছু না পেয়ে পরে ছেড়ে দেয়।'
বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ঢাকামুখী একটি বাসে উঠতে দেখা যায় তাদের। ঢাকার ভেতর আবারও তল্লাশির সম্মুখীন হন কি না এই শঙ্কায় এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল নম্বরও সংগ্রহ করে নিয়ে যান তারা।
বিকেল ৪টার দিকে একই তল্লাশি চৌকিতে একটি মাইক্রোবাস থামিয়ে যাত্রীদের মোবাইল ফোন ঘাঁটতে দেখা যায় পুলিশকে। মোশারফ হোসেন নামে এক ব্যক্তির মোবাইলে কিছু ছবি পায় পুলিশ। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এই সন্দেহে পুলিশ তাকেসহ মাইক্রোবাসের অপর ৭ যাত্রী ও চালককে রাস্তার পাশে অন্তত ৩০ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখে।
সেই মাইক্রোবাসের এক যাত্রী সালাহউদ্দিন সরকার নিজেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয় দিয়ে বলেন, তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা থেকে ঢাকার মালিবাগে যাচ্ছেন, তাদের গ্রামের এক প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। পথিমধ্যে তাদের থামায় পুলিশ।
'আমরা সবাই একই গ্রামের। আমাদের আগে আরও দুটি মাইক্রোবাস চলে গেছে। ফেরি মিস করায় আমাদের দেরি হয়ে যায় এবং তল্লাশির মুখে পড়ি। পুলিশ আমাদের ফোন চেক করেছে, তারপর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পুলিশ এভাবে নাগরিকের মোবাইল চেক করতে পারে কি না আমার জানা নেই', বলেন সালাহউদ্দিন।
৩০ মিনিট পর পুলিশকে আশ্বস্ত করতে পেরে ঢাকায় যাওয়ার অনুমতি পান সালাউদ্দিন ও মোশারফরা। তবে পুলিশ তাদের মাইক্রোবাসের সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে এবং গাড়ির নম্বর লিখে রাখে।
একাধিক তল্লাশি চৌকিতে যাত্রীদের মোবাইল ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য তল্লাশ করার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারও মোবাইল ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য তল্লাশি করার নির্দেশনা কোনো পুলিশ সদস্যকে দেওয়া হয়নি। এমনটা কেউ করেছেন কি না সে ব্যাপারে আমার কাছে তথ্য নেই। তবে কেউ যদি করেও থাকেন তাদের জন্য ভবিষ্যতে এমনটা না করার নির্দেশনা থাকবে।'
'ঢাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কেউ বিস্ফোরক কোনো দ্রব্য বহন করছে কি না আমরা কেবল এটাই তল্লাশ করছি। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ', যোগ করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
সুলতানা কামাল সেতুর পশ্চিম পাশে ডেমরায় ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকিতেও যাত্রীদের মোবাইল ফোনে তল্লাশি চালাতে দেখা গেছে।
শুক্রবার সারাদিনে তল্লাশি চৌকিতে কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া না গেলেও গতকাল সন্ধ্যা থেকে আজ সকাল পর্যন্ত এ জেলায় বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন ৪৫ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের নাশকতার অভিযোগে ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা পুরোনো মামলাগুলোতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
আগামীকাল ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে নেতাকর্মীদের যেতে বাধা দিতে জেলাজুড়ে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে পুরোনো মামলায় গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকন।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। সব নেতাকর্মী ঘরছাড়া। নেতাদের বাড়িতে না পেয়ে পরিবারের লোকজনকে হয়রানি করছে পুলিশ। অপরদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। অবৈধভাবে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে সরকার এই কাজগুলো করছে।'
Comments