পিলখানা হত্যাকাণ্ড

‘৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি’

বনানী সেনা কবরস্থানে নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভে বিএনপির শ্রদ্ধা। ছবি: সংগৃহীত

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আজ শনিবার সকালে বনানী সেনা কবরস্থানে নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে এই অভিযোগ করেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, 'আমরা মনে করি যে, এই ঘটনার যেভাবে তদন্ত হওয়ার দরকার ছিল, যেভাবে সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের এবং এর পেছনে যারা ছিলেন তাদের বের করে নিয়ে আসার যে তদন্ত প্রক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল, সেটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সংঘটিত হয়নি। আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি যে, সেনাবাহিনী একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, সেটার পূর্ণাঙ্গ যে চেহারা সেটা দেশবাসী জানতে পারেনি।'

'পরবর্তীকালে যে বিচারের ব্যবস্থা হয়েছে, সেই বিচারের ব্যবস্থায় আমরা দেখেছি- দুই বিষয়ে বিচার হয়েছে। একটি হলো বিদ্রোহ এবং হত্যা, আরেকটি হলো বিস্ফোরক। সাজা হয়েছে কিছু মানুষের, কিছু মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, কিছু মানুষকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ৭ হাজারের মতো সৈনিক যাদের অনেকে দাবি করেন যে, তারা সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ তাদের কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার শুনানি শেষ করা হয়নি', বলেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, 'আমি কিছুদিন আগে কারাগারে ছিলাম। সেখানে দেখেছি যে, অনেক প্রাক্তন বিডিআরের সদস্য যাদের এই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, তারা ১৩-১৪ বছর ধরে সেখানে অমানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের পরিবার নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে গেছে।'

'আমরা এই দাবি করব, যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, যে জুডিশিয়ারি সমস্যাগুলো আছে, তা অতিদ্রুত সম্পাদন করে এদের একটা ব্যবস্থা করা উচিত, তাদের মুক্তি দেওয়া উচিত। এই বিষয়গুলো দেখে এই মানুষগুলোকে তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার একটা সুযোগ সৃষ্টি করা হোক', বলেন তিনি।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার সদর দপ্তরে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সংস্থাটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এই ঘটনায় হত্যা মামলায় ২০১৩ সালে বিশেষ আদালতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন এবং খালাস পায় ২৭৮ জন।

পিলখানার এই নির্মম ঘটনার পর বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে সংস্থাটি পূর্ণগঠন করে 'বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-(বিজিবি)' নামকরণ করা হয়।

দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নেতৃবৃন্দ তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন।

এসময় কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম, অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মুস্তাফিজুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জহুরুল আলম, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ফয়সাল, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল জয়নাল আবেদীন, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ কামরুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর মিজানুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর নিয়াজ আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর কোহিনুর আলম নূর, অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হারুনুর রশীদ ভুঁইয়া এবং জাগপার খন্দকার লুতফর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, 'আমরা এই দিনে সেই সব চৌকশ কর্মকর্তা যারা আমাদের সম্পদ ছিলেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পরম করুণাময়ের কাছে এই দোয়া চাইছি তিনি যেন তাদের বেহেস্ত নসিব করেন।'

'৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার-পরিজন ছাড়া অন্যান্য যারা হত্যার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতিও আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে, আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে এবং দলের অসংখ্য কোটি নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি', বলেন তিনি।

বিএনপি মহাসচিব বিডিআরের ঘটনায় নিহত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভুঁইয়ার সঙ্গে কথা বলেন  এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে স্মৃতিস্তম্ভে যান।

মির্জা ফখরুল বলেন, 'এই দিনটি দুঃখজনক ও কলঙ্কের দিন। এ দিনে আমাদের তখনকার বিডিআর যাকে আমরা সীমান্তরক্ষা বাহিনী বলতাম, সেই বাহিনীর ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাদের পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করা হয় এবং একটা ভয়াবহ নৃশংস ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করা হয়। এটা একটা চক্রান্ত ছিল দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে, আমাদের গর্বিত সেনাবাহিনীর মনোবলকে ভেঙে ফেলার জন্য।'

তিনি বলেন, 'সেদিনের ২৫ ফেব্রুয়ারির অত্যন্ত ভয়াবহ চক্রান্ত, একটা ষড়যন্ত্র এ দেশের বিরুদ্ধে এই জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আমাদের যে সার্বভৌমত্ব, আমাদের যে স্বাধীনতা তা প্রচণ্ডভাবে সেদিন আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। আমাদের যে মহান মুক্তিযুদ্ধ সেই মুক্তিযুদ্ধেও এতজন সেনা কর্মকর্তাকে হারাইনি।'

'এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, যে উদ্দেশ্য ছিল, সেই উদ্দেশ্য ছিল মূলত আমাদের যে গর্ব সেনাবাহিনী তার মনোবলকে ভেঙে দেওয়া। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্য যারা তাদের প্রাণ উৎসর্গ করেন, যারা শপথ নিয়েছেন তাদেরকে এভাবে সম্পূর্ণ নৃশংসভাবে, অন্যায়ভাবে, বেআইনিভাবে ও পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র ছিল', যোগ করেন তিনি।

'২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার দিন সকাল থেকে বেগম খালেদা জিয়ার গতিবিধি সন্দেহজনক ছিল' আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের এই বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'এটা সম্পূর্ণভাবে দায়িত্বহীন একটা কমেন্ট। এতবড় একটা ঘটনা, যে ঘটনায় আজকে সমস্ত জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ঘটনাগুলো কোনো একজন ব্যক্তি যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তিনি (খালেদা জিয়া) এই দেশের ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ছিলেন।'

'তিনি এ দেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন এবং গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি এখনো কারাবরণ করেছেন, অন্তরীণ হয়ে আছেন। সুতরাং এসব কমেন্ট একেবারেই ডায়ভারসন করা। তাদের সমস্যা হচ্ছে, তারা মূল সমস্যায় না গিয়ে সবসময় অন্য দিকে যেতে চান। কারণ এই ঘটনাগুলো তারা সেভাবে সমাধান করতে পারেননি', বলেন তিনি।

বিএনপির এই নেতা বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, অন্যান্য বাহিনী বিজেপিসহ সবাই আমরা একসঙ্গে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে চাই। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বই হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এজন্য এখন প্রয়োজন সমস্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ফিরে পেতে চাই।'

'আমরা মনে করি, সকল সংকটের মূলে রয়েছে- এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করা, একটি সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা সংকটগুলোর সমাধান করতে পারব', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

4h ago