চাপে সরকার, দিতে পারে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পশ্চিমাদের চাপ এবং দেশের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে পারে সরকার।

ক্ষমতাসীন দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ রাজপথে আধিপত্য বিস্তারে বিএনপির আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি দিলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সঙ্গে পর্দার আড়ালে আলোচনা করার কথা বিবেচনা করছে।

আগামী এপ্রিলের কোনো এক সময় বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে আনার উদ্যোগ নেবে আওয়ামী লীগ।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চাপ দিয়েছে।

তারা ভোটের সময় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের কথা বলেছে, যেখানে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছে।

গত রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে কোনো আইনি বাধা নেই। তার এই মন্তব্যে বিরোধী দলের প্রতি আওয়ামী লীগের নরম সুর স্পষ্ট হয়ে উঠে।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করার সময় সরকার এ ধরনের শর্ত আরোপ করেনি।

৩ বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে একটি দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাবরণ করেন। তাকে ২০২০ সালের মার্চে দেশ না ছাড়ার শর্তে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়।

অথচ, কিছুদিন আগেও খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের রাজনীতিতে ফেরার বিষয়ে আওয়ামী লীগ কড়া শব্দ ব্যবহার করে আসছিল।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে এই হামলা চালানো হয়। এতে অন্তত ২৪ জন নিহত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক মানুষ আহত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিনিয়তই বিএনপি-জামায়াতকে ২০১৩ সালের অগ্নিসংযোগের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করে চিহ্নিত করে এবং বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে থাকার অধিকার নেই বলে দাবি করে।

আওয়ামী লীগের সেই নীতি ও সুর এখন বদলাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

আইনমন্ত্রীর পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন যদি রাজনীতিতে জড়াতে চান তাহলে তাকে তার মুক্তির শর্ত মানতে হবে।

কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক গতকাল বুধবার একই সুরে বলেছেন, খালেদা জিয়া জেল থেকেও তার দল চালাতে পারেন এবং দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিতে পারেন।

তবে এই ৩ মন্ত্রীই বলছেন, খালেদা জিয়া দলীয় কার্যালয়ে যেতে পারবেন না।

এদিকে বিএনপি বলেছে, মন্ত্রীদের এসব মন্তব্য তাদের আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা।

দলটি বলেছে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে তারা কোনো সংলাপে বসবে না।

তারা মনে করছে, বর্তমান প্রশাসনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

গত মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, 'ভবিষ্যতে সরকার এ ধরনের আরও অনেক মন্তব্য করবে। তাদের এসব কথার প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।'

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সংলাপ অপরিহার্য। সংলাপ কখন ও কীভাবে হবে তা সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।'

তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগ এমন একটি নির্বাচন চায় যেখানে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে। একটি পক্ষের মধ্যে সংলাপ হতে পারে না। এর জন্য অপর পক্ষকেও আসতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি সংলাপ শুরু করে তাহলে বিএনপিকেও এগিয়ে আসতে হবে।'

কেন আওয়ামী লীগ চাপে

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল পূর্ববর্তী ২টি নির্বাচনে পশ্চিমাদের অবস্থানের কারণেই নয়, পশ্চিমা বাজার ও অর্থায়নের ওপর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণেও আওয়ামী লীগ সরকার পশ্চিমাদের কাছ থেকে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আরও চাপের মুখে পড়ছে।

২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব এবং এর ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ওই বছর গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানালে সরকার চাপের মুখে পড়ে।

ইতোমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং দেশে দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতি চাপে পড়েছে।

বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে, যেখানে পশ্চিমা প্রভাব প্রবল।

সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে গত ২ প্রান্তিকে বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি পোশাক ক্রেতা, বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগকারী এবং রোহিঙ্গাদের জন্য দাতা।'

আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন ও ফ্রেঞ্চ ইউনিয়ন ডেস ফ্যাব্রিক্যান্টস অভিযোগ করার পর সম্প্রতি মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয় বাংলাদেশের পোশাক খাতে মেধাস্বত্ব অধিকার সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনা শুরু করেছে। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ এবং আরও কয়েকটি দেশ ব্র্যান্ডের নকল পণ্য রপ্তানি করছে।

এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হতে পারে, কোটা বাতিল হতে পারে, এমনকি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নও সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের পথই অনুসরণ করে।

প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পোশাক খাতে রপ্তানি কমে গেলে বাংলাদেশ একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।

ঢাকার একটি দূতাবাসে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, 'এটা সত্য যে পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। কূটনীতিকরা এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এসব নিয়ে কথা বলছেন। ক্ষমতাসীন দল সেদিকে খুব একটা মনোযোগ দেয়নি।'

তিনি বলেন, 'এখন, বাংলাদেশ পশ্চিমাদের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণে।'

'কাজেই পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্রে সরকারের হাতে খুবই কম হাতিয়ার আছে।'

পরিষ্কার পশ্চিমা বার্তা

জাপানও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত নভেম্বরে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গত কয়েক মাসে বিদেশি কূটনীতিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৭ সদস্য রাষ্ট্রের কূটনীতিক নিয়ে একটি প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, 'তারা চায় বিএনপিসহ সব দল আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।

তিনি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আগামী মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ ধরনের আরও বৈঠক হবে। কূটনীতিকরা এটাও স্পষ্ট করবেন যে তারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো সহিংসতা চান না।

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বৈঠকে বলেছিলেন যে তার দেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে। তবে, ভারতও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। দূতাবাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারত চায় বাংলাদেশে একটি প্রাণবন্ত সংসদ থাকুক।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, পশ্চিমা শক্তি বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এটা তাদের নীতি। গত ২টি নির্বাচন বিতর্কিত ছিল। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সরকারও পরোক্ষ চাপ অনুভব করছে।

তিনি বলেন, 'শাসক দল এই চাপের কাছে কতটা মাথা নত করবে সেটা সময় বলে দেবে।'

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

11h ago