স্বাস্থ্য সহায়তা সেবা দিতে ৪ নেটওয়ার্ক গঠনের সুপারিশ কমিশনের

স্বাস্থ্য সহায়তা সেবা দিতে এবং স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা, গুণগত মান এবং আওতা বাড়াতে চারটি জাতীয় সহায়তা নেটওয়ার্ক গঠনের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন।
প্রস্তাবিত এই নেটওয়ার্কগুলো হলো—জাতীয় ফার্মেসি নেটওয়ার্ক (এনপিএন), জাতীয় রোগনির্ণয় পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক, জাতীয় রক্ত সরবরাহ নেটওয়ার্ক এবং জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্ক।
গত সপ্তাহে জমা দেওয়া কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি সেবা নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হবে এবং নিজস্ব সমন্বিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সারাদেশে আন্তঃসংযুক্ত থাকবে। যার মাধ্যমে মানুষ সহজে, দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্যভাবে এসব সেবা যাতে পায় তা নিশ্চিত করা যায়।
এসব সুপারিশ এসেছে এমন এক সময়ে, যখন জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সাধারণ মানুষকে নানা ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হয়।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় চার লাখ নিবন্ধিত ফার্মেসি রয়েছে এবং গড়ে ২২০টি ফার্মেসি প্রতিদিন অনুমোদন পাচ্ছে। তবে এসব ফার্মেসির বেশিরভাগই প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট ছাড়াই পরিচালিত হয়, যার ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রি, ওষুধের ব্যাপক অপব্যবহার এবং একটি অনিয়ন্ত্রিত বাজার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে এই পরিস্থিতি ওষুধের গুণগত মান, চিকিৎসার কার্যকারিতা এবং রোগীর নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
কমিশন সারা দেশে সব সরকারি হাসপাতাল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) ক্লিনিকে ২৪-ঘণ্টা খোলা নিজস্ব লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসি স্থাপনের মাধ্যমে একটি জাতীয় ফার্মেসি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে।
এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাতে বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ পায় তা নিশ্চিত করা।
এই ফার্মেসিগুলোকে জাতীয় প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা অনুসারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধের মজুদ রাখতে হবে এবং পরিষেবাগুলো ভর্তি রোগী এবং হাসপাতালের বহির্বিভাগের রোগী—উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য হবে।
প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্টরা এসব ফার্মেসি পরিচালনা করবেন এবং ওষুধ ব্যবহারের সঠিক নির্দেশনা দেবেন এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারকে উৎসাহিত করবেন।
ওষুধের সরবরাহ এবং বিতরণ ডিজিটালভাবে ট্র্যাক করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের চাহিদার পূর্বাভাস দেওয়া এবং চুরি ও অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ডে একই রকম ব্যবস্থার উদাহরণ টেনে কমিশন জানিয়েছে, এই ধরনের ব্যবস্থা চালু করা হলে অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি ফার্মেসির উপর নির্ভরতা কমবে, সরবরাহ চেইনের স্বচ্ছতা বাড়বে এবং ওষুধ সরবরাহে সরকারি অর্থের ব্যয়-কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
কমিশন সারা দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত জাতীয় অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে। যা শহরাঞ্চল থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সময়মতো, মানসম্পন্ন এবং সমতার ভিত্তিতে জরুরি পরিবহন সেবা নিশ্চিত করবে।
এই নেটওয়ার্কে থাকবে জিপিএস সুবিধাসহ অ্যাম্বুলেন্স, কেন্দ্রীয় কলসেন্টার এবং একটি পর্যায়ভিত্তিক যানবাহন বহর ব্যবস্থা। সরকারি বরাদ্দ, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিল এবং স্বেচ্ছা অনুদানের মাধ্যমে এটি অর্থায়ন করা হবে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
কমিশন জানিয়েছে, সামাজিক ব্যবসা মডেলের ভিত্তিতে আর্থিকভাবে টেকসই কাঠামো গড়ে তুলে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে এই সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত করা যেতে পারে।
ভারত এবং রুয়ান্ডার সফল উদাহরণ তুলে ধরে কমিশন জানায়, যদি দেশে এই ধরনের ব্যবস্থা চালু করা হয়, তাহলে এটি স্বাস্থ্যসেবা পেতে সময় কমাবে এবং দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য জরুরি সেবা সহজলভ্য হবে।
এতে করে ব্যক্তিগত পরিবহনের পেছনে ব্যয়ও কমবে—ফলে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আরও সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যদিও কমিশন একটি জাতীয় রোগ নির্ণয় পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক এবং একটি জাতীয় রক্ত সরবরাহ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে, তবে এই উদ্যোগগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি কমিশন।
Comments