সংক্ষিপ্ত সংস্কার হলে ডিসেম্বরে নির্বাচন, সংস্কার বৃহৎ হলে আগামী জুনে: প্রধান উপদেষ্টা

শুক্রবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বৈঠক করেন। ছবি: সংগৃহীত

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি 'সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ' নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরে, আর যদি 'বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ' নেয়, তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।

আজ শুক্রবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে এক বৈঠকে এ কথা বলেন।

বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব সংস্কার এজেন্ডার প্রতি জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বিশ্বব্যাপী 'সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠী' রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি চার দিনের সফরে গতকাল ঢাকায় আসেন।

আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে নেওয়া সংস্কার কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কক্সবাজারে বসবাসরত দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব অধ্যাপক ইউনূসকে বলেন, 'আমি সংস্কার কর্মসূচির প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করতে চাই। আমরা আপনাদের সংস্কার প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিতে এখানে এসেছি। আমরা আপনাদের সর্বোত্তম সফলতা কামনা করি। যেকোনো সহযোগিতা লাগলে আমাদের জানান।' 

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে এই সংস্কার প্রক্রিয়া একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের একটি 'বাস্তব রূপান্তর' নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, 'আমি জানি যে সংস্কার প্রক্রিয়াটি জটিল হতে পারে'।

গুতেরেস বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে তিনি রমজান মাসে বাংলাদেশে এসেছেন।

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত ১২ লাখ রোহিঙ্গার জন্য মানবিক সহায়তা হ্রাস নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, 'পৃথিবীতে এতটা বৈষম্যের শিকার অন্য কোনো জনগোষ্ঠী আমি দেখিনি'। তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভুলতে বসেছে'।

'মানবিক সহায়তা হ্রাস করা একটি অপরাধ' উল্লেখ করে আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এখন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় দ্বিগুণ করছে, কিন্তু তখন আবার বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা সংকুচিত হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের 'অপরিসীম কৃতজ্ঞতা' প্রকাশ করেন গুতেরেস। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি আমার জন্য একটি বিশেষ বিষয়'।

অধ্যাপক ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিবকে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশ সফরের জন্য ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, 'আপনার আসার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারত না। আপনার সফর কেবল রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও সময়োপযোগী'।

প্রধান উপদেষ্টা গুতেরেসকে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ১০টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দলগুলো ছয়টি কমিশনের সুপারিশসমূহের সাথে একবার একমত হলে, তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে, যা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক, বিচারিক, নির্বাচন সংক্রান্ত, প্রশাসনিক, দুর্নীতি দমন এবং পুলিশ সংস্কারের একটি রূপরেখা হবে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি 'সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ' নিয়ে একমত হয়, তবে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে,  তারা যদি 'বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ' গ্রহণ করে, তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে।

প্রধান উপদেষ্টা 'সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন' নিশ্চিত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

অধ্যাপক ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিবের সহযোগিতা চান, যাতে রোহিঙ্গারা সম্মানের সাথে তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারের পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে পারে। তিনি বলেন, যতদিন তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে ততদিন পর্যন্ত তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও মানবিক সহায়তা যেন নিশ্চিত করা যায়।

তিনি বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের দুর্দশার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি। বিশ্বকে জানতে হবে তারা কতটা কষ্ট পাচ্ছে। তাদের মধ্যে একটা হতাশার অনুভূতি রয়েছে'।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং তাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেবেন।

গুতেরেস বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন।

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম 'অসাধারণ' এবং বাংলাদেশ ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার অগ্রভাগে রয়েছে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন,'বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ'।

অধ্যাপক ইউনূসও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদ্যেদের প্রশংসা করে বলেন, এই মিশনে কাজ করার ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তিনি বলেন,'শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ'।

বৈঠকে ভূ-রাজনীতি, সার্কের বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশেগুলোর সম্পর্কের বিষয় নিয়েও আলোচনায় হয়। অধ্যাপক ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ফোরামকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তার প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হতে চায়।

প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে একাধিক বন্দর নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কেও কথা বলেন, যা নেপাল ও ভুটানসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশকে 'একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র' হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও জাপানসহ প্রায় প্রতিটি দেশের সমর্থন পেয়েছে।

অর্থনীতি প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তাঁর সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত, সংকোচিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙ্গে পড়া অবস্থায় পেয়েছে।

তিনি বলেন, 'অর্থনীতি এখন সুসংহত হয়েছে। রপ্তানি কয়েক মাস ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো অবস্থানে রয়েছে'।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অর্থনীতি এমনভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ।

তিনি বলেন,'আমরা এলডিসি উত্তরণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছি'।

তিনি বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের শাসনামলে লুটপাট হওয়া কয়েকশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত আনার জন্য সরকার চেষ্টা করছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আগের সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনীতির ভঙ্গুর পরিস্থিতি তাকে ১৯৭৪ সালের পর্তুগালের বিপ্লবী দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।

বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলী সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান এবং এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।

জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমা ও বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইসও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

A floating mosaic of guavas, baskets and people

During the monsoon, Jhalakathi transforms into a floating paradise. Bhimruli guava market comes alive with boats carrying farmers, buyers, and tourists.

11h ago