লালফিতায় আটকা গণঅভ্যুত্থানে আহতদের ক্ষতিপূরণ

ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা | স্টার ফাইল ফটো

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া আহতদের অনেকে পঙ্গুত্ব আর অন্ধত্ব নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শহীদদের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ও আহতদের জন্য এক লাখ টাকা করে এককালীন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়।

সারি সারি অনুমোদন আর সিল-ছাপ্পরের সিরিজ শুরু হয় মূলত আবেদনপত্রে বিসিএস চিকিৎসক বা হাসপাতাল পরিচালকের কাছ থেকে সিল নেওয়ার মাধ্যমে। এর সঙ্গে চিকিৎসার প্রমাণস্বরূপ হাসপাতালের টিকিট বা ছাড়পত্র জমা দিতে হয়, যেখানে অবশ্যই এমবিবিএস চিকিৎসকের সিল থাকতে হবে, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে চিকিৎসা অভ্যুত্থানের ওই সময়েই দেওয়া হয়েছিল। পেমেন্টের জন্য রোগীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে সংযুক্ত একটি বিকাশ নম্বর থাকতে হবে। যদি তা না থাকে, তাহলে অভিভাবকের বিকাশ নম্বর ব্যবহার করা যাবে, তবে এটি একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে যাচাই করাতে হবে। এছাড়া, আবেদনের সঙ্গে আঘাতের চিহ্ন বা আহত স্থানের ছবি সংযুক্ত করাও বাধ্যতামূলক।

সমস্ত নথিপত্র প্রস্তুত হওয়ার পর, সেগুলো একটি সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) সংযুক্ত করতে হয়। এরপর, সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় থেকে রোগীর স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হয়। এই যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর, নথিগুলো ব্যক্তিগতভাবে বা ডাক, ইমেইল কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে জমা দিতে হয়।

এসব কাজের জন্য পরিবারগুলোকে একাধিকবার এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটতে হয়। যার খরচও নিজেদের থেকেই দিতে হয়। ঢাকার বাইরে যারা থাকেন তাদের জন্য এটি অত্যন্ত কষ্টকর। অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, তাদের সাত থেকে আটবার পর্যন্ত ফাউন্ডেশনে যেতে হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই হয় অসম্পূর্ণ নথি নয়তো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতির কারণে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

অনেক সময়ই সিভিল সার্জন বা ডিসি অফিসে কাগজপত্র পড়ে থাকে। যা তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়া, ফাউন্ডেশনের হটলাইন নম্বরেও বেশিরভাগ সময় যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না।

জুলাই ফাউন্ডেশন কার্যালয়

গত ২৫ জানুয়ারি জুলাই ফাউন্ডেশনে প্রথমবার যান এই সংবাদদাতা। গিয়ে জানতে পারেন অফিসটি সপ্তাহান্তে বন্ধ থাকে। সহায়তা বা তথ্য নিতে আসা ১১ জন ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং তারা খালি হাতে ফিরে যান।

পরদিন বিকেল ৩টায় গিয়ে দেখা যায় আহত এবং শহীদদের পরিবারসহ অনেক মানুষ সাহায্যের জন্য ফাউন্ডেশনের সামনে অপেক্ষা করছেন।

এক কোণে একটি চেয়ারে বসে কাঁদছিলেন আরাধন বেগম। তার ছেলে ওমর ফারুক গত ২৮ জুলাই পল্টনে গুলিবিদ্ধ হন। ফাউন্ডেশনে এনিয়ে তিনি চতুর্থবার এসেছেন।

ওমরের ইতোমধ্যেই একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে এবং আরেকটি অস্ত্রোপচার কয়েকদিনের মধ্যে হওয়ার কথা। আরাধনের স্বামী ১৯৯৭ সালে মারা যাওয়ার পর ওমরের উপার্জনেই পরিবারটি চলত।

ওমরের নথিপত্রসহ আরও ১১ জনের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবকিছু এখনো নোয়াখালী সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আটকে আছে।

আরাধন তার দুর্দশার কথা জানান। ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসেছেন। এখন নোয়াখালীতে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই তার।

'কিন্তু তারা আমাকে বলছে সেখানে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে,' অসহায় কণ্ঠে বলছিলেন আরাধন।

আরাধন জানান, খুব একটা পড়াশোনা করেননি তিনি। 'আমার ওই ছেলেই আমর সব। আমার একার পক্ষে এসব সামাল দেওয়া খুব কঠিন। একা কীভাবে নোয়াখালী যাব? ছেলের চিকিৎসার জন্য এরই মধ্যে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। তারপরও আমরা কোনো টাকা পাইনি। দরকার হলে ছেলের চিকিৎসার জন্য ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করব।'

আরাধন ফাউন্ডেশনে এসেছিলেন দুপুর ১২টা দিকে আর কাজের কোনো অগ্রগতি ছাড়াই বিকেল ৫টার সময় তিনি চোখে পানি নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান।

মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মোহাম্মদ বেলাল। পরে অস্ত্রোপচারে তার পা কেটে ফেলা হয়। তবে প্রথম অস্ত্রোপচারের পর সংক্রমণ হওয়ায় এখন আরেকটি সার্জারি প্রয়োজন।

বেলালের বাবা উদ্বিগ্নভাবে এদিক-ওদিক ছুটছিলেন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলেন কেন এখনো তার ছেলের ক্ষতিপূরণ আটকে আছে।

প্রথমে তাকে বলা হয়, সিভিল সার্জন এখনো ফাইলগুলো যাচাই করেননি। কিন্তু যখন ছাত্র আন্দোলনকারীরা বিষয়টি ফেসবুকে তুলে ধরেন এবং তা ভাইরাল হয়, তখন জানা যায় জেলা পর্যায়ে নথিগুলো আসলে অনেক আগেই যাচাই হয়ে গেছে। মূলত ফাউন্ডেশনের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল।

বেলালের বাবা যাচাইকাজ দ্রুত শেষ করার জন্য অনুরোধ জানান, কারণ তার ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকাটা অত্যন্ত জরুরি। তবে ফাউন্ডেশন জানায়, তাদের আরও কয়েক দিন সময় লাগবে।

৬০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি সকাল ১০টায় ফাউন্ডেশনে এসেছিলেন এবং সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় যখন এই সংবাদদাতা চলে আসছিলেন তখনো তিনি সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন।

ছররা গুলিতে আহত আরেকজন চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে এসেছিলেন। তিনি কয়েক মাস আগে সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তাকে জানানো হয়, আঘাতের স্থানের ছবি জমা না দেওয়ায় তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন না।

'আমার কোনো মোবাইল ফোন নেই। আমার কাছে কোনো ছবি নেই। শরীরে এখনো অনেক ছররা গুলি রয়ে গেছে, আর আমার চিকিৎসার নথিপত্রেই তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তাহলে ছবির কী দরকার?'

তিনি আরও বলেন, 'আমি শনিবার ফাউন্ডেশনে এসেছিলাম, জানতাম না যে এটি বন্ধ থাকবে।'

তিনি জানান, রাত কাটিয়েছেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে খোলা আকাশের নিচে।

'চিকিৎসার জন্য আমার টাকাটা খুব দরকার', কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন তিনি।

হতাশার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আরও অনেকের কণ্ঠেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফাউন্ডেশনের এক কর্মী জানান, জালিয়াতি ঠেকাতে যাচাই প্রক্রিয়া কঠোর করা হয়েছে।

তবে দেরির প্রধান কারণ সিভিল সার্জন বা ডিসি কার্যালয়ে ফাইল আটকে থাকা। তিনি আরও বলেন যে ফাউন্ডেশনে মাত্র ৩৫ জন কর্মচারী আছে, যা এই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়।

ভিকটিমদের অব্যাহত বাধা

জুলাই ফাউন্ডেশন কার্যালয় প্রাঙ্গণে সাক্ষাৎকার নেওয়া ২০ জন ছাড়াও এই প্রতিবেদক ৭ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন।

তাদের মধ্যে খুব কম মানুষ সহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু তাদের মতে, সেই সহায়তা পেয়েছেন 'নিজেদের আত্মমর্যাদা ও সময়ের বিনিময়ে।'

অনেকেই এখনো অপেক্ষা করছেন। তাদের আবেদনপত্র আটকে আছে সেই লাল ফিতার মধ্যেই।

যেমন: গত ২২ জানুয়ারি সাংবাদিক তরিক হাসান বাপ্পি ফেসবুকে আফনান সাবিককে নিয়ে একটি লেখা শেয়ার করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফনান মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে আহত হয়েছিলেন এবং এখনো ক্ষতিপূরণের অপেক্ষা করছেন।

পরদিন পোস্টটি ভাইরাল হলে এবং জুলাই ফাউন্ডেশনের নজরে আসার পর, তারা তাকে জানায় যে তার বাবার নামের বানান একটি নথিতে ভুল ছিল। ফলে তাকে পুরো প্রক্রিয়া আবার শুরু থেকে শুরু করতে হবে।

এই ভুল করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের নাম তালিকাভুক্ত করেছিলেন যারা তারা। কিন্তু এখন আফনানকেই এর দায় ভোগ করতে হচ্ছে।

আফনান বলেন, 'প্রথমে আমি আমার নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য ঢামেক হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কর্মকর্তারা আমাকে এদিক-সেদিক ঘোরায়। একটা কাজের জন্য পুরো হাসপাতালেই আমি ঘুরি। এটা আসলে বলে বোঝানো খুব মুশকিল।'

'তারপর তারা আমাকে যশোরে গিয়ে সিভিল সার্জনের সই নেওয়ার জন্য পাঠান। সিভিল সার্জন কয়েকদিন ধরে আমার ফাইল আটকে রাখেন। তারপর একদিন সকালে, যশোরের একজন ছাত্র সমন্বয়কারী এবং সিভিল সার্জন অবশেষে (ফেসবুক পোস্টের কারণে) এদিকে মনোযোগ দেন।'

'এখন আমাকে পুরো প্রক্রিয়াটি আবার শুরু করতে হচ্ছে কারণ তারা একটি ভুল করেছে!'

এরপর রয়েছে শহীদ আবদুর রহমানের ঘটনা।

শহীদ আব্দুর রহমানের ছেলে ফয়সালকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার শাহবাগে ফাউন্ডেশনে চেক সংগ্রহ করতে কমপক্ষে আট বার আসতে হয়েছে।

অষ্টমবারের সময় ফয়সালকে জানানো হয় যে একটি চেক ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু এটি আবদুর রহমানের ১১০ বছর বয়সী মায়ের নামে, যিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকেন। ফাউন্ডেশন থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল দুর্বল, শয্যাশায়ী সেই বৃদ্ধাকে ঢাকায় এসে চেকটি নিতে হবে!

'আমার দাদি যিনি নড়াচড়াও করতে পারেন না, তিনি কীভাবে ঢাকায় আসবেন?', বলছিলেন ফয়সাল।

এই ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করলে, একটি 'সমাধান' প্রস্তাব করা হয়েছিল। চেকটি আব্দুর রহমানের স্ত্রীর নামে পুনরায় ইস্যু করা হবে। তবে, টাকা কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জে নগদ বা ক্যাশ করা যাবে ১১০ বছর বয়সী দাদির উপস্থিতিতে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে, যারা নিশ্চিত করবেন যে তহবিল সুষ্ঠুভাবে বিতরণ হচ্ছে।

গত ২৩ জানুয়ারি জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রধান সংগঠক সারজিস আলম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

সিইও মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধের নেতৃত্বে নির্বাহী কমিটি এখন জুলাই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম তদারকি করবে।

ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন বলেন, শহীদদের জন্য কাগজপত্র তৈরি করা খুবই সহজ ছিল এবং ফাউন্ডেশনে তিনজন মনোনীত ব্যক্তি—বাবা, মা ও স্ত্রী—রয়েছেন।

'তবে, যখন সবাই দাবি করে তখন একক মনোনীত প্রার্থী নির্বাচন করা জটিল হয়ে পড়ে।'

আহতদের ক্ষেত্রে, কাগজপত্রগুলো প্রথমে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়।

তারা নিশ্চিত করলে আমরা আমাদের যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শুরু করি।

জাহিদ বলেন, সাধারণত কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এনআইডি ও বিকাশ নম্বরের মধ্যে মিল নেই। তারপর, আমাদের তাদের ব্যাংক বিবরণ বা অন্য একটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট সংগ্রহ করতে হয়।'

তিনি স্বীকার করেন যে দেরি হচ্ছে। তবে কোনো ভুয়া দাবিদার যাতে টাকা না পায়, তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয়। যদি কেউ ভুয়া আঘাতের তালিকাভুক্ত হয়, তাহলে এটি প্রকৃত বীরদের প্রতি অবমাননা হবে।

তিনি বলেন, ফাউন্ডেশনের ৩৫ জন কর্মী ছাড়াও, যাচাইকরণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য ১৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক মাঠে রয়েছেন।

'এখন পর্যন্ত ৬৭৩ শহীদ পরিবার এবং দুই হাজার ৩৯৬ জন আহত আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।'

জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারিভাবে নিহতের সংখ্যা ৮২৬ জন এবং আহত প্রায় ১১ হাজার বলে জানিয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Excavator brought to demolish Dhanmondi-32

An excavator was brought to Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Dhanmondi-32 residence tonight following social media announcements of a "Bulldozer Procession" to get rid of the "pilgrimage site of fascism"

4h ago