পদোন্নতি দ্বন্দ্বে মুখোমুখি ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা

সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কিছু সুপারিশ প্রকাশ করার পর বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার ও অন্যান্য ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে। দ্বন্দ্ব মূলত তাদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত, এতে জনস্বার্থ অনুপস্থিত।

এখন পর্যন্ত ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা গোলটেবিল বৈঠক করেছেন, সংবাদ সম্মেলন করেছেন, 'কলম বিরতি' কর্মসূচি পালন করেছেন এবং আজ বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করার ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি, দাবি আদায় না হলে ৪ জানুয়ারি ঢাকায় মহাসমাবেশ করার হুমকিও দিয়েছেন।

অন্যদিকে গত রোববার বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কয়েকশ কর্মকর্তা সচিবালয়ে একত্রিত হয়ে জনপ্রশাসন সচিবের দপ্তরে একটি স্মারকলিপি জমা দেন।

সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক এসব কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, 'ক্যাডার কর্মকর্তারা যা করছেন, তা আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ে তারা যদি ট্রেড ইউনিয়নের মতো আচরণ করেন, তাহলে জাতি তাদের কাছ থেকে কী আশা করতে পারে?'

তিনি বলেন, 'ক্যাডার কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের অন্যতম সুবিধাভোগী ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তারা যদি এভাবে প্রতিবাদ করে, গণসমাবেশের হুমকি দেয়, এ ধরনের আন্দোলনে জড়িয়ে পরে, তাহলে জনগণ ও নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা কী শিক্ষা পাবে?'

কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৭(ক), ২৩(ক), ২৯(গ) ও ৩০ ধারা এবং ২০১৬ সালের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের নির্দেশিকার ৯(ক), ৯(ছ) ও ৯(ঞ) ধারা লঙ্ঘন করেছেন বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস (প্রশাসন) ওয়েলফেয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এক সমাবেশে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সমালোচনা করেছে। তারা দাবি করেছেন, 'জনপ্রশাসন সংস্কারের নামে গভীর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।'

বিসিএস (প্রশাসন) ওয়েলফেয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সভাপতি এবিএম সাত্তার দাবি করেছেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ভেঙে দিতে হবে এবং এর চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে হবে।

তিনি বলেন, 'যদি কমিশনের চেয়ারম্যান পদত্যাগ না করেন, তাহলে আমরা জানি কীভাবে দাবি আদায় করতে হয়।'

রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন অডিটোরিয়ামে আয়োজিত বিক্ষোভে তিনি জানান, দাবি না মানলে ৪ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করবেন তারা।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী গত ১৭ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য আলাদা সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া, প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারদের মধ্য থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতির অনুপাত ৫০:৫০ করার সুপারিশ করবেন।

বর্তমানে এই অনুপাত ৭৫:২৫।

এই প্রস্তাব প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। তারা বলছেন, উপসচিবের মতো পদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত এবং এটি অন্য ক্যাডারদের জন্য নয়।

দ্য ডেইলি স্টারকে একজন যুগ্ম সচিব বলেন, '১০০০ নম্বরের মধ্যে ৬৫০ পাওয়া ব্যক্তি এবং ৮৫০ পেয়ে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিকে সমান সুযোগ দেওয়া অযৌক্তিক।'

বাকি ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা মনে করেন, উপসচিব ও এর ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতি হওয়া উচিত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। তারা দাবি করেন, এসব পদ কোনো নির্দিষ্ট ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত নয়।

এই বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলছে।

অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা এ বিষয় নিয়ে আদালতেও গিয়েছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পর ৭৫:২৫ অনুপাতে এই পদোন্নতি দেওয়া হয়।

প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের অন্যতম নেতা ও ঢাকার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে রায় দিয়েছে যে উপসচিব পদের ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষণ করা বৈধ। এই রায় দেওয়া বিচারকদের মধ্যে পাঁচজন পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।'

তিনি বলেন, 'বাস্তবে উপসচিব ও এর ঊর্ধ্বতন পদগুলো মূলত প্রশাসন ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত। এই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত সংস্কার আনার মাধ্যমে এবং এই পদগুলোর শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের আওতায় এনে।'

এদিকে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের জন্য আলাদা সার্ভিস কমিশনের প্রস্তাবনার বিরোধিতা করেছেন। এই ক্যাডারের প্রতিনিধিরা ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ৪ জানুয়ারি রাজধানীতে সমাবেশের ঘোষণা দেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যসচিব মো. মোখলেস উর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কমিশনের খসড়া সুপারিশগুলো চূড়ান্ত হয়নি।'

তিনি বলেন, 'আমরা এখনো বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করছি এবং কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে সবার মতামত নেওয়া হবে। আমরা একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারব বলে আশা করছি।'

কমিশন আজ প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।

সারা দেশে ২৬টি ক্যাডারের প্রায় ৫৫ হাজার কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ছয় হাজার ৩৪২ জন প্রশাসন ক্যাডারের।

২০১০ সালে আপিল বিভাগের রায় সাময়িকভাবে এ বিষয়ে বিরোধ থামিয়ে দিলেও ২০১৭ সালে উপসচিব ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়ি সুবিধা দেওয়ার পর এটি আবার নতুন করে আলোচনায় চলে আসে।

সেই সময় হাসিনা সরকার উপসচিবদের ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত গাড়ি ঋণ দেওয়া শুরু করে। পাশাপাশি, তারা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা ভাতা পান এবং প্রাপ্ত ঋণের প্রায় অর্ধেক টাকা পরিশোধ করলেই হয়।

এই সুবিধা অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পাননি।

ফলে বাকি ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারাও একই ধরনের সুবিধা দাবি করেন। কিন্তু তাদের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর ফলে তারা উপসচিব পদে পদোন্নতির অনুপাত বাড়ানোর দাবি জোরালো করতে মনযোগী হন তারা।

৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এবং পরবর্তীতে সংস্কার কমিশন গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের দাবির পক্ষে বিভাগীয় শহরে সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, গোলটেবিল বৈঠক ও অন্যান্য কর্মসূচির আয়োজন করেন।

তথ্য ক্যাডারের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা শুধু গাড়ি সুবিধাই পান না, শূন্য পদ না থাকলেও তারা পদোন্নতি পান।'

তিনি বলেন, 'এই সুবিধা অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা কল্পনাও করতে পারেন না।'

কৃষি ক্যাডারের এক কর্মকর্তা জানান, হাসিনা সরকারের পতনের পর উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে ব্যাপক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, 'এমনকি বিভাগীয় মামলায় দোষী সাব্যস্ত কর্মকর্তারাও পদোন্নতি পেয়েছেন। শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই কি সরকারের কাজ করছেন?'

শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, '৭৬৪ জন প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তার পদোন্নতি চূড়ান্ত হয়েছে, এর ফলে তারা চাকরিতে না থাকার পরও সম্মান ও আর্থিক সুবিধা পাবেন।'

'এমনকি তাদের মধ্যে অনেককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হবে। অন্য ক্যাডারের জন্য তা হয়নি, এটাই বাস্তবতা,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Consensus key to reforms, election

Chief Adviser Muhammad Yunus yesterday said reforms without consensus and elections without reforms would not be able to take Bangladesh forward.

8h ago