অভ্যুত্থানে শহীদ-আহতদের কেউ সেবা ও পুনর্বাসন থেকে বাদ যাবে না: প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের কেউ সেবা ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা থেকে বাদ যাবে না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে আজ রোববার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন তিনি। 

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'গণ-অভ্যুথানে সব শহীদদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। একজনও বাদ যাবে না। সব আহত শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। আহতদের দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিটি শহীদ পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'যারা বুলেটের আঘাতে তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, তাদের চিকিৎসার জন্য নেপাল থেকে কর্নিয়া আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবং যাদের প্রয়োজন তাদের সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের কোনো শহীদ এবং আহত ছাত্র-শ্রমিক চিকিৎসা সেবা ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা থেকে বাদ যাবে না। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অঙ্গীকার।'

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'এই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে গঠিত "জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন" বেশ পাকাপোক্তভাবে তাদের কাজ শুরু করেছে। এই ফাউন্ডেশনে সরকার ১০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়াও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বরাদ্দ প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের পর আমরা এমন একটি দেশ হাতে পেয়েছি যার সর্বত্র ছিল বিশৃঙ্খলা। স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিপ্লব চলাকালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার শহিদী মৃত্যু হয়। আমাদের সরকার প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য অত্যন্ত যত্নের সাথে জোগাড় করছে। এই বিপ্লবে আহত হয়েছে ১৯ হাজার ৯৩১ জন। আহতদের জন্য ঢাকার ১৩টি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিনই তালিকায় আরও নতুন নতুন শহীদের তথ্য যোগ হচ্ছে যারা স্বৈরাচারের আক্রোশের শিকার হয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।'

'পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে' মন্তব্য করে ড. উপদেষ্টা বলেন, 'বাধ্য হয়ে তাদের অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা জনরোষের শিকার হয়েছেন। এতে তাদের মনোবল অনেক কমে যায়। আমরা পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে এনে তাদের আবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে অনেক দৃশ্যমান উন্নতিও হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেও কিছু নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতিতে সহায়তা করেছে।'

'আমি আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই, কঠিন এই সময়ে আপনারা সবাই অপরিসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানাই দেশের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে। তারা তাদের কর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিশোধ স্পৃহায় লিপ্ত হয়ে কেউ যাতে হানাহানিতে জড়িয়ে না পড়ে সেই আহ্বান জানিয়েছেন। আপনাদের সবাই এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদী শক্তি ভয় দেখিয়েছিল তারা ক্ষমতা ছাড়লে দেশে লাখ লাখ লোক মারা পড়বে। টানা সাত দিন পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকার পরও ব্যাপক আকারে সহিংসতা এড়ানো গেছে,' বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, 'আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি, বাংলাদেশ তখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত একটা দেশ। এসময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা সহিংসতারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু এটা নিয়ে যে-সব প্রচার-প্রচারণা হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত। অল্প যেসমস্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমরা দৃঢ়ভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি।'

'আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাসের মাথায় দেশে দুর্গাপূজা উদ্‌যাপিত হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার পূজা মণ্ডপে। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে নির্বাহী আদেশে একদিন অতিরিক্ত ছুটি ঘোষণা করা হয় যা উৎসবের আমেজকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।  দূর্গাপুজাকে ঘিরে আমরা ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি নেই। যার ফলে, দেশের হিন্দু সম্প্রদায় নির্বিঘ্নে তাদের উৎসব পালন করেছে। আমরা দায়িত্বে আসার পর যে অল্প কিছু ক্ষেত্রে তারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন আমরা তার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করছি। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ই নয়, দেশের কোনো মানুষই যাতে কোনো রকম সহিংসতার শিকার না হয়, সেজন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এবং সব সময় সে চেষ্টা করে যেতে থাকবো,' যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আপনারা জানেন চলতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয়টি বন্যা হয়েছে। আপনাদের সবার সহযোগিতায় আমরা এই বন্যা মোকাবিলা করেছি। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী বন্যা মোকাবিলায় জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। বন্যা মোকাবিলা ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান এবং স্থানীয় অনুদানের মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে।'

'বন্যার ফলে অনেক জায়গায় ফসলহানি হয়েছে, ব্যাহত হয়েছে পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল। বন্যা পরবর্তী সময়ে বাজারে শাক-সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে আপনাদের কষ্ট হয়েছে। নিত্য পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বাজারে ডিমের সরবরাহ বাড়ানো জন্য আমরা সাড়ে নয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছি। এজন্য প্রয়োজনীয় শুল্ক ছাড়ও দেওয়া হয়েছে।  মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ডিমের উৎপাদনকরা যাতে সরাসরি বাজারে ডিম সরবরাহ করতে পারে সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'

'মানুষ যাতে স্বল্প মূল্যে কৃষি পণ্য কিনতে পারে সেজন্য রাজধানীসহ বিভিন্ন স্পটে সরকারি কিছু পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি নিম্ন আয়ের ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যে ৫৭ লাখকে স্মার্ট কার্ডে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বন্যার ফলে চালের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। আসন্ন রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ও দাম যাতে স্বাভাবিক থাকে এজন্য সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছে। দ্রব্য মূল্য নিয়ে আমাদের কোনো লুকোছাপা নেই। মূল্যস্ফীতির পূর্ণ তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি রোধে উচ্চ সুদের হার নির্ধারণসহ একাধিক নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে শস্য আমদানিতে এলসি সীমা অপসারণ এবং সরবরাহ চেইন সংক্ষিপ্ত করা,' যোগ করেন তিনি।

ড. ইউনূস বলেন, 'সামান্য হলেও জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়েছে। শিল্প কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ব্যাহত না হয় এবং রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। গণ-শুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম না বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আশা করি বাজারে পণ্যমূল্য কমিয়ে আনতে এটা ভূমিকা রাখবে। নেপাল থেকে পানিবিদ্যুত বাংলাদেশে আনার ব্যবস্হা করা হয়েছে।'

প্রধান উপদেষ্টার পুরো বক্তব্যটি পড়তে লিংকে ক্লিক করুন।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh transition from autocracy to democracy

Transitioning from autocracy to democracy: The four challenges for Bangladesh

The challenges are not exclusively of the interim government's but of the entire political class.

11h ago