অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরকে আইনি জটিলতায় ফেলে গেছে আ. লীগ সরকার
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ সময় ব্যয় করেও একটি আন্তর্জাতিক সালিশি দাবির নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ আইনি জটিলতায় পড়েছে। এই ঘটনার জেরে গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে সরকারি সফরকালে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হঠাত করেই মার্কিন আদালতের বিচারিক আদেশ আসে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতায় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিগগির আপিল আবেদন করা হয়। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরকে মার্কিন আদালতে ব্যাখ্যা দিতে যাওয়ার আদেশটি তুলে নেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদের সময়। ১৯৯৭ সালে মার্কিন বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান স্মিথ কোজেনারেশনকে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর অনুমোদন দিয়েছিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই বছরের মাথায় পিডিবি সেই চুক্তি বাতিল করে এবং ওই প্রতিষ্ঠানের জমা দেওয়া দেড় লাখ ডলার বাজেয়াপ্ত করে।
১৯৯৯ সালের ১ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) অধীনে যুক্তরাজ্যের এক আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে পিডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে স্মিথ কোজেনারেশন। সেখানে তারা চুক্তি বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশের কাছ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ দাবি করে।
পিডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই আদালত ২০০২ থেকে ২০০৩ সাল নাগাদ কয়েক দফা শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর রায় দেয়। শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষে একটি আইনি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হলেও পরবর্তীতে আইনি মতভেদে পিডিবির কোনো প্রতিনিধি সেই শুনানিতে অংশ নেয়নি। ফলে একপাক্ষিক রায় পায় প্রতিষ্ঠানটি।
রায়ে বলা হয়, 'স্মিথ পিডিবির বিরুদ্ধে মুনাফার প্রাক্কলন ও তাদের ওই সময়ের ব্যয় হিসেবে ১০ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হওয়ার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এছাড়া পিডিবি এই আদালতের সালিশের খরচ হিসেবে ৬ লাখ ডলার ও স্মিথের মামলা চালানোর খরচ ৫ লাখ ডলার দেবে।'
একই সঙ্গে আদালত ঋণ পরিশোধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চার শতাংশ হারে সুদ ধার্য করে দেয়।
এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানটি একাধিকবার চেষ্টা করেও টাকা আদায় করতে পারেনি। সুদসহ বর্তমানে এর পরিমাণ ৩১ দশমিক নয় মিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাজ্যের রায়কে স্বীকৃতি দিতে ও অর্থ আদায় করে দিতে স্মিথ কোজেনারেশন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক আদালত এবং স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কোর্ট অব সেশনেও ধর্না দিয়েছে।
সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর এই স্মিথ কোজেনারেশন পিডিবিকে চিঠি দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের নাম উল্লেখ করে ২৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ব্যাখ্যা দিতে নোটিশ পাঠায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সে সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন।
২৩ অক্টোবর শুনানিতে বাংলাদেশ পক্ষের কাউকে না পেয়ে আদালত দুজনের নামে বেঞ্চ ওয়ারেন্ট জারি করে। অবশ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেটি স্থগিতও হয়।
গত মঙ্গলবার পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা নোটিশ পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু খুবই অল্প সময়ের নোটিশে শুনানির আগে সব নথি তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, যখন চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে, তখন সব প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করেই বাতিল করা হয়েছে।
নতুন দায়িত্ব নেওয়া চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, 'খোঁজ নিয়ে যতটুকু বুঝেছি, এটা সালিশি আদালতেই মিটে যেত বলে আমাদের আইনজীবীদের ধারণা। শুরুতে একটি ল ফার্মকে নিযুক্ত করলেও তখন সরকার বা পিডিবি সালিশি আদালতে কোনো চ্যালেঞ্জ জানায়নি। তারা বাংলাদেশের একটি আদালতে এ নিয়ে একটি মামলা করেছিল। সেই মামলার কার্যক্রম এখনো চলছে।'
তিনি বলেন, 'নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করা তো দূরের কথা, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজই শুরু করেনি প্রতিষ্ঠানটি। তাদের প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে তদন্ত করে কিছুই পাওয়া যায়নি। সেখানে কোনো যন্ত্রপাতি বা নির্মাণ উপকরণও ছিল না।'
প্রতিষ্ঠানটি সময়সীমা সংশোধনের আবেদন করলেও পিডিবি তা নাকচ করে চুক্তি বাতিল ও বন্ডের টাকা বাজেয়াপ্ত করে।
দ্য ডেইলি স্টার গত বছরের ৭ নভেম্বর সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও সাবেক বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমানকে লেখা স্মিথ কোজেনারেশনের একটি চিঠি দেখেছে।
তাতে প্রতিষ্ঠানটি ২০ মিলিয়ন ডলার দাবি করে বলেছে, 'এই বিরোধের ফলে স্মিথ কোজেনারেশনের অনেক ক্ষতি হয়েছে। দয়া করে মনে রাখবেন যে মার্কিন আইন অনুসারে এদেশের কোনো আদালত ব্রিটেনের আদালতের রায় কার্যকর করতে পিডিবি এবং বাংলাদেশ সরকারকে মোটেও আলাদা করে দেখবে না। কারণ সরকার আমাদের কাজের নিঃশর্ত গ্যারান্টি দিয়েছিল।'
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন নসরুল হামিদ। আর অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার আগে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান ৬ অক্টোবর পর্যন্ত অফিস করেছেন।
মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন লেখার সময় তার ব্যক্তিগত মুঠোফোন বন্ধ ছিল। স্মিথ কোজেনারেশনের আইনজীবীদের একজন হ্যারল্ড ই প্যাট্রিকফকে ডেইলি স্টার ইমেইলের মাধ্যমে লিখিত প্রশ্ন পাঠিয়েছে, যার উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।
Comments