এবার সেই হিন্দু বাড়ির দরজা খুলে নেওয়ার অভিযোগ, মামলা তুলে নিতে হুমকি

গত ১৬ অক্টোবর বাড়ি থেকে দরজা খুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী পরিবার। ছবি: সংগৃহীত

কিশোরগঞ্জের ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামের একটি হিন্দু পরিবারে হামলা চালিয়ে কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ ও আসবাবপত্র লুটে নেওয়ার পর এবার সেই বাড়ির দরজা খুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় স্থানীয় রশিদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সদস্য ইদ্রিস মিয়াসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে গত শুক্রবার কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে লুটপাটের ঘটনায় একই থানায় মামলা দায়ের করা হলেও এখনও কেউ আটক হয়নি বলে জানিয়েছে পরিবারটি।

এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত ওই হিন্দু পরিবারের সদস্যরা প্রায় ৩ মাস ধরে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আছেন। প্রাণভয়ে বাড়ি ফিরতে সাহস পাচ্ছেন না।

গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) থানায় জমা দেওয়া লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী গীতা রাণী বর্মন উল্লেখ করেন, গত ১৬ অক্টোবর দিনগত রাত ১০টার দিকে বিএনপি নেতা ইদ্রিস মিয়ার নির্দেশে তার ১০/১৫ জন সহযোগী ওই বাড়ির দালান ঘরে ঢুকে কাঁঠাল কাঠের তৈরি তিনটি দরজা খুলে নিয়ে যায়। এরপর তারা আগের মামলা উঠিয়ে নিতে তাদেরকে হুমকি দেয়।

এলাকাবাসী জানায়, ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামের প্রয়াত জয় কৃষ্ণ বর্মনের বাড়িতে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন ইদ্রিস দলবল নিয়ে ওই বাড়িতে হামলা চালায়। শুধু তাই নয়, উল্টো ওই পরিবারের এক সদস্যকে রাজনৈতিক হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

৫ আগস্ট হামলা-লুটপাটের পর ওই পরিবারের পক্ষ থেকে এ ঘটনার বিচার চেয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্দেশে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা ইদ্রিস মিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

হিন্দু পরিবারটির অভিযোগ, আগের ঘটনার পর পুলিশের কাছে গেলেও শুরুতে মামলা নিতে চায়নি তারা। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের হস্তক্ষেপে স্থানীয় থানা মামলা নিয়েছে।

মামলার বাদী গীতা রাণীর ভাই প্রদীপ বর্মণ ডেইলি স্টারকে জানান, ঘটনার পরদিন ৬ আগস্ট তারা থানায় মামলা করতে গেলে শুরুতে পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয়নি। পরে পুলিশের সদর দপ্তরে যোগাযোগ করা হয়। এরপরও ঘটনার ৪৮ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর মামলাটি এফআইআরভুক্ত করে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার পুলিশ। ওই মামলায় ইদ্রিসসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু এই মামলার পর আরেকটি মামলা দায়ের করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। আসামিরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বাদী পক্ষকে দেশছাড়া করাসহ হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

আগের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় অভিযোগ করা হয়, ৫ আগস্ট বিকেল ৩টা নাগাদ ইদ্রিসের নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি দল তাদের বাড়িতে ঢুকে হামলা-ভাঙচুর শুরু করে। তাদের কাছে হকিস্টিক, ককটেল ও পিস্তল ছিল। তারা সেখানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় ও পিস্তল দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। পরে সন্ধ্যার পর পিকআপে করে ইদ্রিসের নেতৃত্বেই ৩০-৪০ জন এসে বাড়ির প্রধান ফটক খুলে নেওয়াসহ ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ, খাট, সোফা, আলমারি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন, সাবমারসিবল মোটরসহ সবকিছু গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

কে এই ইদ্রিস মিয়া

২০১৬ সালের ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ব্রাহ্মণকচুরি গ্রামের বাসিন্দা ইদ্রিস মিয়া। মূলত ঢাকায় ভাঙ্গারি পণ্যের ব্যবসা রয়েছে তার। বিগত সময়ে ঢাকা ও টাঙ্গাইলে মোবাইল ফোন টাওয়ারের চোরাই মালামাল কেনার অপরাধে তার নামে একাধিক মামলা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি সাজা ভোগ করেন। এ ছাড়া প্রায় ১৮ বছর আগে ঢাকায় নিজ গ্রামের একজনকে হত্যার দায়ে তিনি কারাভোগও করেছিলেন।

নিজ এলাকায় ইদ্রিসের পেশীশক্তির প্রভাব থাকায় কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেলের ঘনিষ্ঠভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। স্থানীয়ভাবে 'ভিপি সোহেল' নামে পরিচিত এই বিএনপি নেতার রশিদাবাদ এলাকায় একাধিক মুরগি ও মাছের খামার থাকার কারণে তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ফলে জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতার 'আশীর্বাদ' কাজে লাগিয়ে ইদ্রিস এলাকায় দাপট দেখান বলে অভিযোগ আছে।

ইদ্রিস মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি যেহেতু এলাকার চেয়ারম্যান ছিলাম, আমার প্রতিপক্ষ আছে। তারা পরিকল্পিতভাবে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। গত বুধবারের ঘটনাটি সম্পূর্ণ সাজানো। আর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ওই হিন্দু বাড়িতে আপামর জনতা হামলা করেছে।'

ঘটনার সঙ্গে আপনি জড়িত না থাকলে বিএনপি আপনাকে কেন বহিষ্কার করল জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাকে রাজনৈতিকভাবে 'কুরবানি' করা হয়েছে। আমি বিএনপির গ্রুপিংয়ের শিকার হয়েছি। প্রতিহিংসা থেকে বিএনপির একটা পক্ষ আমার বিরুদ্ধে নেমেছে।

কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানা থেকে সদ্য বদলি হয়ে যাওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শ্যামল মিয়া বলেন, 'দরজা খুলে নেওয়ার অভিযোগ পেয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. আল আমিন হোসাইনসহ আমরা ওই বাড়িটি পরিদর্শন করি। সেখানে গিয়ে আমরা ঘরটি আগের মতোই তালা লাগানো দেখতে পাই। ওই বাড়িতে কেউ যায়নি বলে জানতে পারি।'

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. আল আমিন হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পরের বার হামলার যে অভিযোগটি করা হচ্ছে সেটি ভুল। আমি সরেজমিনে গিয়ে ৫ আগস্টের ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। দ্বিতীয় অভিযোগ পেয়ে সেখানে গিয়ে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। পরবর্তী সময়ে ওই বাড়িতে কোনো হামলার ঘটনা পাইনি। ওই বাড়ির ভেতরে কয়েকটি কক্ষের দরজা ৫ তারিখে নেওয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। দ্বিতীয়বার হামলার কোনো তথ্য প্রমাণ পাইনি।'

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago