দুর্মূল্যের বাজারে বিধবা মালেকাদের ৫৫০ টাকার জীবন!

৭০ বছর বয়সী মালেকা বেগম বিধবা হয়েছেন প্রায় পাঁচ দশক আগে। ১৯৭২ সালে তার স্বামী আবুল হোসেন গাজী মারা যাওয়ার পর থেকে তার জীবন চলছে নিরন্তর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে।

একমাত্র ছেলেকে বড় করতে তিনি গৃহপরিচারিকা ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু, শরীর এখন আর এসব কাজ করতে সায় দেয় না। ভারী কাজ করতে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই এখন তার জীবন চলে অন্যের কৃপায়।

স্থানীয় কর্মকর্তা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে কয়েক বছর ধরনা দেওয়ার পর প্রায় এক দশক আগে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিধবা ভাতার কার্ড পান পটুয়াখালীর এই নারী।

শুরুতে প্রতিমাসে তিনি পেতেন ৩০০ টাকা, যা এখন বেড়ে ৫৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

মঙ্গলবার জেলার আউলিয়াপুর গ্রাম থেকে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'মোবাইলে প্রতি তিন মাস পরপর এক হাজার ৬৫০ টাকা পাই। শেষ হতেও সময় লাগে না। সবকিছুর যে দাম, এই কয়েকটা টাকা দিয়ে আর কী কেনা যায় বলেন?'

তার ছেলে খোকন গাজী (৫০) দিনমজুর। যখন যে কাজ পান, সেটাই করেন। কিন্তু, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকায় নিয়মিত কাজ পাওয়াও কঠিন। যেদিন কাজ পান, সেদিনের আয়ের টাকা থেকে যতটা পারেন মাকে দেন।

তবে অনেক দুস্থ মানুষের মাঝে মালেকাকে খানিকটা ভাগ্যবানই বলা যায়। কেননা, তিনি অন্তত প্রতি তিন মাসে এক হাজার ৬৫০ হলেও পান। অনেকে সেটাও পান না।

মোবাইলে প্রতি তিন মাস পরপর এক হাজার ৬৫০ টাকা পাই। শেষ হতেও সময় লাগে না। সবকিছুর যে দাম, এই কয়েকটা টাকা দিয়ে আর কী কেনা যায় বলেন?

মালেকা বেগম

বগুড়ার শাহজাহানপুর এলাকার ৬০ বছর বয়সী আজিমা বিবি বয়স্ক ভাতা পাওয়া জন্য চেষ্টা করছেন। এখন পর্যন্ত তিনি সফল হয়নি। তার স্বামী কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই নিজেই গৃহপরিচারিকার কাজ করে যৎসামান্য আয়ে কোনো রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে আজিমা বলেন, 'ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের কাছে বয়স্ক ভাতার কার্ডের কথা জানতে অনেকবার গিয়েছি। প্রতিবারই শুধু বলে দেন, আমার নাম এখনও তালিকায় আসেনি।'

অর্থনীতিবিদ ও দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানো এবং টাকা পরিমাণ পুনর্বিবেচনা করা খুবই জরুরি বিষয়। এটা এমন একটি পরিমাণে দেওয়া দরকার, যাতে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী, যেমন: বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের সেটা যথাযথভাবে কাজে আসে।

তাদের ভাষ্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানো আরও বেশি জরুরি হয়ে পরেছে। কারণ, দরিদ্র মানুষ এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় রয়েছে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি কমেছে।

২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ১৯ মে পর্যন্ত ঢাকায় ৩৪টি প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর গড় দৈনিক মূল্যের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে এসব পণ্যের দাম ১০ শতাংশ থেকে ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যের ভিত্তিতে এই বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের কাছে বয়স্ক ভাতার কার্ডের কথা জানতে অনেকবার গিয়েছি। প্রতিবারই শুধু বলে দেন, আমার নাম এখনও তালিকায় আসেনি।

আজিমা বিবি

কে কত পায়

সর্বশেষ খানার আয় ও ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) ২০২২ এর তথ্য অনুসারে, দেশের জনসংখ্যা ১৮ দশমিক সাত শতাংশ বা তিন কোটি ১৭ লাখ মানুষ দরিদ্র—যারা দিনে গড়ে দুই দশমিক ১৫ ডলারের বেশি আয় করে। আর জনসংখ্যার পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ বা ৯৫ লাখ মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র—যাদের গড় দৈনিক আয় দুই দশমিক ১৫ ডলারের নিচে।

বাজেট তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দরিদ্র, চরম দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য এক লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দে ১৪০টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি রয়েছে।

এই বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক সরকারি কর্মচারীদের অবসরকালীন সুবিধা এবং সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ পরিশোধে চলে যায়।

চলতি অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন দিতে ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে আট হাজার ৮২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

সেই তুলনায় দরিদ্ররা পায় সামান্যই।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য দেখায়, সবচেয়ে দুরবস্থায় থাকা বিধবা, বয়স্ক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য মাসিক ভাতা যথাক্রমে ৫৫০, ৬০০ ও ৮৫০ টাকা।

বিধবা ভাতা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ অর্থবছরে। তখন চার লাখ মানুষকে জনপ্রতি প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হতো। গত ২৫ বছরে তা বেড়েছে ৪৫০ টাকা।

তথ্য অনুযায়ী, বয়স্ক ভাতা এর এক বছর আগে চালু হয়েছিল। এই খাতেও তখন চার লাখ মানুষকে জনপ্রতি প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হতো। এই ভাতা বেড়েছে মাত্র ৫০০ টাকা।

২০০৬ অর্থবছরে এক লাখ মানুষের প্রতিজনের জন্য ২০০ টাকা করে বরাদ্দ দিয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা চালু হয়। ১৪ বছর লেগেছে জনপ্রতি ৬৫০ টাকা ভাতা বাড়তে।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বয়স্ক ভাতাপ্রাপ্ত সমেস উদ্দিন বলেন, 'এই টাকা দিয়ে পাঁচ কেজি চাল ও এক কেজি মাছও কেনা কঠিন।'

যারা এর বাইরে

যৎসামান্য টাকা দেওয়া হলেও যথাযথ ব্যক্তি বাছাইয়ে ত্রুটির কারণে অনেক যোগ্য ব্যক্তি এই সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বাইরেই রয়েছেন।

গত বছর 'সোশ্যাল সেফটি নেট বাজেট অব বাংলাদেশ: ক্যাচিং সাম, মিসিং ম্যানি' শীর্ষক সিপিডির এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আনুমানিক ৩৩ লাখ বয়স্ক মানুষ ও ২৫ লাখ বিধবা—যারা এই সহায়তা পাওয়ার যোগ্য—এই কর্মসূচির আওতায় নেই।

গত জুলাইয়ে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'প্রতি মাসে প্রত্যেক সুবিধাভোগীর জন্য এই কম বরাদ্দ বাংলাদেশের সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। এটা অস্পষ্ট যে, কেন বাজেটের পর বাজেটে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিপুল সংখ্যক ছোট ছোট কর্মসূচি চালাচ্ছে।'

গতকাল বুধবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান একই কথা বলেন। তার ভাষ্য, সরকারের উচিত সুনির্দিষ্টভাবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে আনার দিকে নজর দেওয়া।

তিনি বলেন, 'এ ছাড়া, যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়েও ত্রুটি আছে। ফলে সুবিধাবঞ্চিতদের পরিবর্তে অনেক অযোগ্য ব্যক্তি ভাতা পাচ্ছেন। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির পুরো বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।'

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল স্বীকার করেছেন যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে যে ভাতা দেওয়া হয় তা অপর্যাপ্ত। তবে তিনি মনে করেন, ব্যক্তিপর্যায়ে এই অর্থ বেশ সহায়ক হয়।

সবাইকে এই বলয়ের মধ্যে আনতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, 'সরকার ধীরে ধীরে এই বলয় সম্প্রসারণ করছে। এর অংশ হিসেবে এ বছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে তালিকায় যুক্ত হয়েছে। শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা এর সম্প্রসারণ এবং টাকার পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন।'

তবে মালেকা বেগমের ছেলে খোকন গাজীর যেন প্রাণ ওষ্ঠাগত। তিনি বলেন, 'এক কেজি করলার দাম ৮০ টাকা আর একটা ডিমের দাম ১৬ টাকা হলে আমরা কীভাবে বাঁচব?'

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া সংবাদদাতা মোস্তফা সবুজ এবং পটুয়াখালী সংবাদদাতা সোহরাব হোসেন)

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago