‘শ্রমিকদের কথা বলার অধিকার থাকতে হবে’
তৈরি পোশাক খাতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ এবং তাদের দাবি ও দুর্দশার বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার।
দ্য ডেইলি স্টার: 'বহিরাগতরা' বারবার অস্থিরতা সৃষ্টি করছে বলে যে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, এর কি কোনো সত্যতা আছে? নাকি এটি ন্যায্য মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনকে দুর্বল এবং শেষ পর্যন্ত দমন করার একটি উপায়?
তাসলিমা আখতার: শুধু পোশাক খাত নয়, গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন সেক্টর থেকেই দাবি-দাওয়া উঠছে। গত ১৫ বছর মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাবে মানুষ প্রাণ খুলে কথা বলতে পারেনি। শ্রমিকরাও এর বাইরে ছিল না। দাবি তুললে বা কথা বললেই চাকরি হারানোসহ নানা ভয় ছিল। সেই ভয় পেরিয়ে শ্রমিকরাও কথা বলতে শুরু করেছে। বকেয়া বেতন পরিশোধ, কারখানা ভিত্তিক আশু ও মজুরি মূল্যায়নসহ দীর্ঘমেয়াদি দাবিও তারা তুলছেন, যার ন্যায্যতা আছে।
কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থও এখানে কাজ করছে। শ্রমিকদের আন্দোলন এবং ক্ষোভকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে গণঅভ্যুত্থানের অর্জনকে নস্যাতের চেষ্টা আছে। ফলে আমরা মনে করি শ্রমিকদের সতর্ক থাকতে হবে যেন এবার 'বহিরাগত', 'উসকানিদাতা', 'ষড়যন্ত্র' ইত্যাদি শব্দে তাদের প্রকৃত দাবি হারিয়ে না যায়। দ্রুত কর্ম পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকার ও উদ্যোক্তাদের বিশেষ প্রেক্ষাপট বিচারে শ্রমিকদের দাবি আদায়ে আশু পদক্ষেপ নেওয়া ও দীর্ঘমেয়াদি সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া জরুরি। এই খাতে যুক্ত শ্রমিক ও শ্রমিক নেতৃত্বসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ইতিবাচক উদ্যোগ নিতে হবে৷ শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার প্রতিউত্তরে দমনের ভাষা বা কৌশল ব্যবহার করলে সেটি কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। শ্রমিকদের মন জয় করার চেষ্টা করতে হবে। দমনের পথে গেলে তার পরিণতি কী হয়, তা গণঅভ্যুত্থানই প্রমাণ করেছে।
সকলের জানা, প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা এবং সংগঠন করার সুযোগ না থাকায় শ্রমিকরা প্রায়শই স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাই শ্রমিকদের কথা বলা ও প্রকৃত ইউনিয়ন করার সুযোগ প্রশস্ত করা উচিত। শ্রমিকরা সতর্ক-সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হলে নিজেদের রুটি-রুজির জায়গায় রক্ষায় তারাই এগিয়ে আসবে। আর যারা বর্তমান প্রেক্ষাপট ব্যবহার করে শ্রমিক ও শিল্পর স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে, সেটা তদন্ত করা এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া মালিক ও সরকারের দায়িত্ব। অন্যের দায় শ্রমিকদের কাঁধে চাপিয়ে তাদের দাবিকে খাটো করার পুরোনো কায়দা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ডেইলি স্টার: শ্রমিকদের দাবিগুলো কী কী?
তাসলিমা আখতার: শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে বিশেষভাবে আছে বকেয়া বেতন পরিশোধ দাবি। শোনা যাচ্ছে প্রায় ২৬ শতাংশ কারখানায় এখনো বেতন পরিশোধ হয়নি। এ ছাড়া স্বৈরশাসকের শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কারখানাসহ বেশ কিছু কারখানা বন্ধ থাকায় বেকারত্ব শঙ্কা বাড়ছে। কারখানাভিত্তিক কিছু দাবি সামনে উঠেছে যার মধ্যে টিফিন বিল, হাজিরা বোনাস, নাইট বিল, ছুটির টাকা, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধিসহ একাধিক দাবি শ্রমিকরা তুলছেন৷ বর্তমান বাজারে বেঁচে থাকা দায় বলেই দাবিগুলো উঠে এসেছে। এর মধ্যে কিছু কারখানায় কারখানাভিত্তিক কিছু দাবি পূরণ হয়েছে। উদ্যোক্তারা টিফিন বিল ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে।
প্রায় দুই সপ্তাহ অর্ধশতাধিকের বেশি কারখানা নানা সময়ে বন্ধ ছিল। কোনো কোনা কারখানায় মালিকরা ১৩/১ ধারায় বন্ধ রেখেছিল। বেক্সিমকোর মালিকসহ এই খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে লোন পেলেও শ্রমিকদের দাবি ঝুলিয়ে রাখে। এ অবস্থায় দ্রুত বকেয়া বেতন পরিশোধ করা জরুরি। শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি রেশনিং নিশ্চিত করা। এই মুহূর্তে এটা সময়ের দাবি। কারণ, গত বছর শ্রমিকরা ২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি করলেও সেখানে সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরি। এই বাজারে এই মজুরিতে চলা যে কঠিন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মজুরি মূল্যায়নসহ ধাপে ধাপে শ্রমিকদের অন্যান্য দাবি বিবেচনায় এনে কারখানা খুলে দিয়ে কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকের রুটিরুজি ও রপ্তানি—দুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ডেইলি স্টার: শ্রমিকরা কী কী বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং বিগত সরকারের কর্মকাণ্ড কীভাবে ক্ষতির কারণ হয়েছে?
তাসলিমা আখতার: গত ১৫ বছর ধরে সরকার কারখানা মালিকদের প্রতি প্রচণ্ডভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। সংসদ সদস্যর একটা বড় অংশ এই খাতের মালিক ছিলেন। বিগত সরকারকে মালিকের সরকার বলেই মনে হতো। ২০২৩ সালে শ্রমিকরা ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করলে শ্রমিক নেতৃত্বসহ শত শত শ্রমিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। চারজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। বহু শ্রমিক কাজও হারিয়েছেন। মজুরি বোর্ড শ্রমিক, মালিক, নিরপেক্ষ প্রতিনিধি বা সরকারসহ সব পক্ষ মিলেমিশে মালিকস্বার্থে একাকার ছিল। তাই শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর যথাযথভাবে সামনে আসেনি।
গত ১৫ বছরে কারখানা ইতিহাসের দুটি ভয়াবহতম কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড: তাজরীন ও রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ড। তাজরীনে শতাধিক এবং রানা প্লাজায় এক হাজার ১৭৫ জনের বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। এখনো দোষীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। তাজরীনের মালিক জামিনে বাইরে এবং মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি বনেছেন। রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা জেলে থাকলেও বাকিরা জামিনে বাইরে। প্রায় ১২ বছরে হতে চলল রানা প্লাজা ও তাজরীন হত্যাকাণ্ডের, অথচ বিচারকার্য হয়নি। যেটি এখন পুনরায় তদন্ত ও দ্রুত বিচার সম্পন্ন প্রয়োজন।
এ ছাড়া খেয়াল রাখা দরকার, ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরাও নানাভাবে শ্রমিক আন্দোলনকে দ্বিধা-বিভক্ত করে আসছে। শ্রমিক এলাকাগুলোতে স্বৈরাচারী সরকারের নানা ক্ষমতাসীন ও সুবিধাভোগী পক্ষ এবং মালিকরা এক হয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হতে নানাভাবে বাধা দিত। দুষিত চক্র চালু রাখা ছিল, যাতে প্রকৃত সৎ নেতৃত্ব না গড়ে ওঠে। স্বৈরাচারী সরকার 'শ্রমিক নেতা' নামধারী এবং পকেট ইউনিয়নসহ এমন গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করত, যারা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেত। টাকা ও ভয় ছড়ানো ছিল তাদের কৌশল। এই কৌশল ও পুরোনো সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শ্রমিক আন্দোলন ও ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে যাতে নতুন কোন সিন্ডিকেট তৈরি না হতে পারে, সে বিষয়ে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে।
বিগত সরকার যে শ্রমিক আন্দোলন ও ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট তৈরি করেছিল, বর্তমানে সেসব সিন্ডিকেটই বুমেরাং হয়ে তাদের ব্যক্তি ও দলগত সুবিধার জন্য শিল্পখাতের ক্ষতিসাধনে ব্যস্ত। শ্রমিকদের সচেতনতা ও সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনই এই শিল্পখাতকে বিকশিত করতে পারে। প্রকৃত আন্দোলন এবং শ্রমিক ও শিল্পখাতে সৎ নেতৃত্ব শ্রমিক ও শিল্প—দুইয়ের স্বার্থই দেখে। তাই শ্রমিক স্বার্থের পক্ষে প্রকৃত ইউনিয়ন ও ব্যক্তি সুবিধার বাইরে সৎ নেতৃত্ব যাতে কাজ করতে পারে, সেজন্য সরকার ও মালিক—উভয়কে নজর দিতে হবে।
ডেইলি স্টার: কেন ক্রেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যাচ্ছে না? রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে শ্রমিকরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমান আলোচনায় কেন এই ব্যাপারটি কিছুটা উপেক্ষিত বলে মনে হচ্ছে?
তাসলিমা আখতার: ক্রেতারা লাভের সিংহভাগ নিতে লুটোপুটি খান। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ানো কিংবা নানা সংকটকালীন অবস্থায় দায়িত্ব নিতে নারাজ থাকে। করোনাকাল থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট মূল্যস্ফীতিসহ নানা সময়ে শ্রমিকদের দুরবস্থায় বায়াররা সব দায় কেবল স্থানীয় উদ্যোক্তা ও সরকারের ওপর চাপিয়েছে। কিন্তু এই দায় বায়ারদেরও গ্রহণ করতে হবে। শিল্পখাতে প্রভাব ফেলে এমন যেকোনো সংকটকালে কথায় কথায় অর্ডার বাতিল না করে শিল্প ও শ্রমিকের স্বার্থে বায়ারদেরও সচেষ্ট থাকতে হবে। এই বিষয়ে সরকার ও উদ্যোক্তাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ একটি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের অংশ। এ খাতে উন্নয়নের জন্য বায়ারদের সঙ্গে দরকষাকষিতে আরও পারদর্শী হতে হবে। একইসঙ্গে বায়ারদের দায়বদ্ধতা জবাবদিহিতাকে কাঠামোগত জায়গায় আনতে হবে। রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে শ্রমিক-মালিক, শিল্পখাত ও দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা জরুরি।
ডেইলি স্টার: চলতি বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। পোশাকশ্রমিকদের জীবনে এ ধরনের ঘটনা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে, বিশেষ করে তাদের স্বল্প মজুরির কারণে?
তাসলিমা আখতার: মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির চাপে দেশবাসীর বেহাল দশা। মধ্যবিত্তদেরও বাজারের বাজেটে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। সেখানে সবচেয়ে বেশি চাপ পোশাক শ্রমিকসহ শ্রমজীবীদের জীবনে পড়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতনে শ্রমিকদের জীবন বিপর্যস্ত। প্রতিবার মজুরি বৃদ্ধির সময় এলে ছেলে ভোলানোর মতো সরকারের কাছ থেকে রেশনের আশ্বাস আসে, যা কখনো বাস্তবায়ন হয় না। বিগত স্বৈরাচারী সরকার তার আমলে এক কোটি পরিবারকে রেশন কার্ড দিয়েছিল, সেটিও দুর্নীতি ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পোশাকশ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম ভূমিকা রাখলেও তাদের খাদ্য-বস্ত্র-চিকিৎসা-শিক্ষা-বিনোদনসহ মৌলিক অধিকার পূরণের ব্যবস্থা তাদের মজুরি কাঠামো বা সরকারি উদ্যোগে নেই। নতুন বাংলাদেশে শ্রমিকরা প্রত্যাশা করে অন্তর্বর্তী সরকার ও মালিকরা শ্রমিক ও শিল্প দুইয়ের স্বার্থই দেখবেন। মজুরি মূল্যায়ন করবে এবং নতুন কর্ম পরিবেশ তৈরি করবে, যাতে শ্রমিকদের কথা বলার জন্য কালো তালিকাভুক্ত হতে না হয়, যাতে শ্রমিকদের মত প্রকাশের অধিকার থাকে। কথায় কথায় ছাঁটাই, হামলা-মামলা, চাকরি হারানোর ভয় থেকে মুক্ত হলে দেশীয় শিল্প ও উৎপাদন বিকাশে শ্রমিকরা আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে।
Comments