থানচির দুর্গম এলাকায় খাদ্য সংকট কাটেনি এখনো

বান্দরবানের থানচিতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকার ২১টি পাড়ার দুই হাজারের বেশি বাসিন্দা খাদ্য সংকটে আছেন। পরিবারের ৬-৮ সদস্যের জন্য এক পট চালের ভাতের সঙ্গে বনের আলু,বাঁশকোড়ল মিশিয়ে যে পাতলা খাবার বানানো হয় তাই খেয়েই দিন কাটাচ্ছেন তারা। 

জুমের নতুন ধান আসার আগ পর্যন্ত এ খাবার খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে দুর্গম এলাকার এই মানুষদের।

বেশ কিছুদিন আগেই খবর পাওয়া যায়, সীমান্তের কাছাকাছি রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নং ওয়ার্ডের মেনহাত পাড়া, বুলু পাড়া, ইয়ংদং পাড়া ও তাংখোয়াইং পাড়া, ম্রংগং পাড়াসহ আশপাশের ২১টি পাড়ার বাসিন্দারা খাদ্য সংকটে পড়েন। ঘরে চাল না থাকায় ভাতের বিকল্প হিসেবে প্রায় এক-দেড় মাস ধরে তারা বাশঁকোড়ল খেয়ে বেঁচে আছেন।

এ খবরের সত্যতা নিশ্চিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর ওই পাড়াগুলোর উদ্দেশে রওনা দেয় স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল। সঙ্গে থানচি উপজেলার বলিপাড়া ৩৮ ব্যাটালিয়নের ২০ জন বিজিবি সদস্যও ছিল।

সরেজমিনে দেখা যায়, থানচি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে সাঙ্গু নদীর উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকার প্রায় ৬৪টি পরিবারের বসবাস। তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে স্থানীয় বাজার বা হাটে যেতে পারেন না।

এসব দুর্গম এলাকার ১৩টি গ্রামের শিশু-বৃদ্ধসহ পাঁচ শতাধিক মানুষেরা খাবারের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছেন গত আড়াই মাস ধরে।

বুলু পাড়া থেকে ১ ঘণ্টা পাহাড়ি পথে হেঁটে বাংলাদেশের সর্ব পূর্বের শেষ গ্রাম মেনহাত পাড়া পৌঁছে দেখা যায়, সেখানে মোট ১৪টি বাড়িতে ১৮টি ম্রো পরিবারের বাস। বাড়িঘরগুলো বাঁশের খুটি, বেড়া ও বাঁশের পাতা দিয়ে তৈরি। বেশিরভাগ ঘর জরাজীর্ণ।

সেখানকার বাসিন্দা রেংওয়ে ম্রো দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিবারের চার সদস্যের একবেলা খেতে চাল লাগে দেড় কেজি চাল। এক মাস আগে বাড়িতে ১০ কেজির একটু বেশি চাল ছিল। এই চাল জুমের নতুন ধান আসার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তখন খাদ্য সংকটে পড়তে হবে। তাই তিনবেলার পরবর্তে একবেলা খাই।'

তিনি জানান, চাল বাঁচাতে পরিমাণ কমিয়ে আধা কেজি দিয়ে সঙ্গে বাঁশকোড়লের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে তরল খাবার খেয়ে তারা বেঁচে আছেন।

খাদ্য সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে রেংওয়ে বলেন, 'ইউপি সদস্যের মাধ্যমে ১০ কেজি করে দুইবার চাউল পাই। ম্রো ছাত্র সংস্থার মাধ্যমে ২৫ কেজি পাই। এই ত্রাণের চালের ওপর বেঁচে আছি। গত ১২ দিন আগে পাওয়া ত্রাণ সহায়তা যাবে বড়জোর ১০ দিন পর্যন্ত। এরপর হয়তো কারো কাছ থেকে ধার করতে হবে নয়তো জুমের আধা-পাঁকা ধান কেটে সেটাকে সেদ্ধ করে অথবা ভেজে ঢেকিতে ভেঙে খাওয়া ছাড়া কোন উপায় দেখছি না।'

একই পাড়ার বাসিন্দা দৌনক ম্রো বলেন, 'আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়জন। একবেলা খেতে লাগে প্রায় আড়াই কেজি চাল। আমাদেরও ভুগতে হচ্ছে খাদ্য সংকটে। তিনবারে ত্রাণ হিসেবে পাওয়া ৪৫ কেজি চালও প্রায় শেষের পথে। জুমের ধান এখনো পুরোপুরি পাকেনি। আরও ১২-১৫ দিন লাগতে পারে। এ সময় পর্যন্ত কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে অপেক্ষায় থাকতে হবে।'

বড় মোদক বাজারে স্থানীয় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, তাদের ইউনিয়নের প্রায় বেশিরভাগ মানুষ জুমের ওপর নির্ভরশীল। গত বছর ভয়াবহ বন্যার কারণে জুমের পাকা ধান ভেসে গেছে। অনেকেই জুম থেকে ১০ কেজির বেশি ধান ঘরে তুলতে পারেনি। তাই এ বচহর এমন খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

সীমান্তবর্তী এলাকার বুলুপাড়া কারবারী (পাড়া প্রধান) বুলু ম্রো ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর আমাদের এলাকায় অতিবৃষ্টি হওয়ায় বন্যায় জুমের ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আমাদের খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। একদিকে ঘরে ধান ও চাল শেষ, অন্যদিকে বৃষ্টি ও বন্যার কারনে থানচি বাজারে গিয়ে চাল নিয়ে আসতে পারছি না। প্রায় তিন মাস ধরে অল্প চালের সঙ্গে বাঁশকোড়ল মিশিয়ে পাতলা খাবার খেয়ে বেঁচে আছি।'

এই পাড়া প্রধান আরও বলেন, 'এর আগে সাংবাদিকরা আমাদের গ্রাম, মেনহাত পাড়া ও অন্যান্য গ্রামগুলো পরিদর্শনের পর সংবাদ করায় সরকার থেকে দুই ধাপে ২৭ কেজি আর আদিবাসী ছাত্রদের কাছ থেকে ২৫ কেজি চাল, ১ কেজি নাপ্পি, ২ কেজি লবন ও ১ কেজি শুটকি পেয়েছি।'

তার বাড়িতে ঢেকিতে ধান ভাঙতে দেখা যায়। তার ছেলের বউ হাতে ধান নিয়ে ম্রো ভাষায় বলেন, 'রাতে একবেলা রান্নার পর ঘরে চাল শেষ। তাই গতকাল জুমে গিয়ে আধা-পাকা ধান কেটে নিয়ে এসেছি। পরে সেগুলো রোদে দিয়ে হালকা শক্ত হওয়ার পর আজ ভাঙছি।'

ধান ভাঙানোর পর ঝুড়িতে রাখা চালগুলো ভাঙা দেখা গেল। বোঝা গেল, ধানগুলো পরিপক্ব হওয়ার আগেই কেটে নিয়ে আসা হয়েছে।

খাদ্য সংকটের বিষয়ে জানতে রেমাক্রি ইউপি চেয়ারম্যান মুই শৈথুই মারমাকে ফোন করা হলে, সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে থানচির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেমাক্রি ইউনিয়নটা অত্যন্ত দুর্গম। তার মধ্যে যে পাড়াগুলোতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে নেই কোনো নেটওয়ার্ক। একমাত্র নৌকা ছাড়া যাতায়াতের বিকল্প কোনো পথ নেই। খাদ্য সংকটের খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশের পর ডিসি স্যার ও রেমাক্রি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে ওই এলাকায় দুই মেট্রিক টন জরুরি খাদ্য সামগ্রী পাঠিয়েছি। এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমেও চার মেট্রিক টন খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়েছি।'

সীমান্ত এলাকা থেকে ফিরে কথা হয় ৩৪ ব্যাটালিয়নের জোন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাইমুর রহমান খানের সঙ্গে। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এলাকাগুলো অত্যন্ত দুর্গম, যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ও বিপজ্জনক হওয়ায় সেখানকার জনমানুষের বাস্তবতা ও দুর্বিষহ জীবনের তথ্য সঠিকভাবে আসে না।'

জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, 'দুর্গম এলাকায় খাদ্যাভাবের কথা জানি। ইতোমধ্যে থানচির ইউএনওকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। জুমের নতুন ধান ঘরে না তোলা পর্যন্ত পাহাড়ে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত খাদ্য সংকট থাকে। তাই একটি নোট লিখে রাখতে বলেছি যেন পরবর্তীতে কেউ এখানে এলে যেন এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে পারে।'

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Child victims of July uprising: Of abandoned toys and unlived tomorrows

They were readers of fairy tales, keepers of marbles, chasers of kites across twilight skies. Some still asked to sleep in their mother’s arms. Others, on the cusp of adolescence, had just begun to dream in the language of futures -- of stethoscopes, classrooms, galaxies. They were children, dreamers of careers, cartoons, and cricket.

10h ago