সংবিধানের নতুন পর্যালোচনা প্রয়োজন: ড. কামাল হোসেন

সংবিধানের নতুন পর্যালোচনা প্রয়োজন: ড. কামাল হোসেন
ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সংবিধানের নতুন পর্যালোচনা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।

তিনি বলেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার নিয়েই বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল। এবারের আন্দোলনে আবারও বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি সামনে এসেছে। তাই ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার কোনো সুযোগ যাতে না থাকে, সে আলোকেও সংবিধানের সুপারিশ করা উচিত।'

বক্তব্যে কামাল হোসেন আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি কীভাবে মৌলিক অধিকারের ক্ষুণ্নতা একটি জাতিকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ জন্যই আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং এই অধিকারগুলো রক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে হবে। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর আমাদের সামনে একটি গুরু দায়িত্ব এসেছে আমাদের সংবিধানের নতুন পর্যালোচনা করার। এই প্রেক্ষাপটে আবুল মনসুর আহমেদের সংবিধান চিন্তা ও দূরদশিতা আমাদের পথ দেখাতে পারে।'

মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত 'আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান চিন্তা, জুলাই অভ্যুত্থান ও সাংবিধানিক সংস্কার' শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ। অনুষ্ঠানের শুরুতে কাজী নজরুল ইসলামের 'সাম্যের গান গাই' অনুসরণে আবুল মনসুর আহমদের প্যারডি কবিতা ট্যাক্শের গান গাই পরিবেশন করেন লেখক ও সাংবাদিক আমিরুল মোমেনিন মানিক। 

সভাপতির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, 'আবুল মনসুর আহমদ সর্বদা গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত গণতন্ত্রই একটি জাতির সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। সাম্প্রতিক বিপ্লবের মূলে ছিল সেই গণতন্ত্রেরই অভাব। বাংলাদেশের বঞ্চিত তরুণ-তরুণীরাই এই অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এই কথাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।'

অনুষ্ঠানের শুরুতে কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্যের গান গাই’ অনুসরণে আবুল মনসুর আহমদের প্যারডি কবিতা ট্যাক্শের গান গাই পরিবেশন করেন লেখক ও সাংবাদিক আমিরুল মোমেনিন মানিক। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান। অনুষ্ঠানে মূল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পার্লমেন্টারি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. জালাল ফিরোজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, লেখক ও গবেষক ডা. জাহেদ উর রহমান, লেখক সারোয়ার তুষার।

মূল প্রবন্ধে সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান বলেন, 'নতুন করে সংবিধান বিনির্মাণ জরুরি। এ জন্য বাহাত্তরের সংবিধানকে পুরোপুরি বাদ না দিয়ে তার কিছু অংশ ভবিষ্যতে নির্মিত সংবিধানে পুনঃস্থাপন করা উচিত। বাহাত্তর সালে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আমরা যেসব নীতি গ্রহণ করেছি নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য, আমরা যেসব নীতির নিশ্চয়তা দিয়েছি, তার বেশির ভাগই ১৯৫০ সালের ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশনের ইশতেহারে আবুল মনসুর তুলে এনেছিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে যে চারটি মূল নীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। এর মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতা ছাড়া বাকি তিনটি নিয়ে আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭০ সালেই আলাদা প্রবন্ধ লিখেছেন। আর ধর্মনিরপেক্ষতা তিনি আজীবন ধারণ করেছেন।'

আরিফ খান তার বক্তব্যে আরও বলেন, 'সংবিধান একটি আধুনিক ধারণা। মধ্যযুগে সংবিধানের প্রয়োজন হয়নি, কারণ তখন রাজা যা বলতেন, তাই আইন হতো। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকারের যে নবজাগরণ তৈরি হয়েছে, এরপরই সারা পৃথিবীতে সংবিধান গ্রহণের ধারা তৈরি হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে যত সংবিধান লিখিত হয়েছে, কোনো সংবিধানের বয়সই গড়ে ১০ বছরের বেশি অতিক্রম হয়নি। দেখা গেছে, এর আগে হয়তো সংবিধান বাতিল বা অচল করে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধান ৫৩ বছর ধরে টিকে আছে!'

সারোয়ার তুষার বলেন, 'আমাদের সংবিধানের মূল নীতিগুলো রাষ্ট্রের সদিচ্ছার বিষয়। মৌলিক অধিকার জনগণের বিষয়। সংবিধান যেহেতু জনগণের ইচ্ছা-অভিপ্রায় তাই মৌলিক অধিকারকে প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে। সংবিধান শুধু আইনজীবীরা ব্যাখ্যা করবেন না। সংবিধান যেহেতু জনগণের দলিল, সেহেতু তারা বলতেই পারেন সংবিধান তাদের অভিপ্রায়ের সঙ্গে আছে  কি নেই! সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনার মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা হয়নি, বরং তা ছেদ ঘটানো হয়েছে। জনগণ গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ফেরার চেষ্টা করেছে।'

জালাল ফিরোজ বলেন, 'আবুল মনসুর আহমদ কখনো স্রোতে গা ভাসাননি। তিনি সব সময় স্রোতের প্রতিকূলে চলতেন।  আবুল মনসুর আহমদ পাকিস্তানের গণ পরিষদে পাকিস্তানের সংবিধান নিয়ে আলোচনায় ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন। তিনি বিরোধী দলীয় সদস্য হিসেবে একনাগাড়ে দুই দিনে সাত ঘণ্টা সংবিধানের ওপরে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাকে সে সময় এডমান্ড বার্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। তিনি প্রথম সংবিধানের ওপর ১৬৭ মিনিট সংশোধনী এনেছিলেন।'

মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, 'বাংলাদেশের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের শব্দটা কোথা থেকে এসেছে? রিপাবলিকের বাংলা কী করে আমরা প্রজাতন্ত্র করি। রিপাবলিক তো গণ মানুষের কথা বলে। প্রজাতন্ত্র তো রাজার প্রজার কথা বলে। ব্রিটিশ রাজের ভাষা এটি ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণ কেন প্রজা হবে! কেন এটি জনগণতন্ত্র নয়? সংবিধানকে সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করা ভীষণ জরুরি।'

'আবুল মনসুর আহমদের সংবিধান চিন্তা, জুলাই অভ্যুত্থান ও সাংবিধানিক সংস্কার' শীর্ষক অনুষ্ঠানে উপচে পড়া ভিড়, ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

ডা. জাহেদ উর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, 'সংবিধান প্রশ্ন আমরা রাখব কি রাখব না, কতটুকু রাখব, কীভাবে রাখব এই বিতর্কটি চলবে এবং নতুন সংবিধান হয়ে যাওয়ার পরেও এই বিতর্কটি চলবে এটিই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। একইসঙ্গে আমাদের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার সংবিধানের কোন কোন জায়গায় আমরা সমস্যা দেখছি।'

অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য রাখেন আবুল মনসুর আহমদের পুত্র এবং ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কবি ও গবেষক ইমরান মাহফুজ।

অনুষ্ঠানে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদ ও তর্কজালের উদ্যোগে জাতীয় বক্তৃতা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা। প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন ফাতেমা ফারজানা নির্জনা, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন মামুনুজ্জামান স্নিগ্ধ, তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন মোহাম্মদ আজিজুল হাকিম, চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন দেওয়ান ফারিহা তাসনিম, পঞ্চম স্থান অধিকার করেছেন চন্দ্রিকা মণ্ডল ও ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছেন রুবিনা জাহান তিথি।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

12h ago