তৃণমূলে আলোকবর্তিকাবাহী ৫ নারীকে সম্মাননা
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজ করে চলা পাঁচ জন নারীকে 'আনসাং উইমেন নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ড-২০২৩' প্রদান করা হয়। তারা তাদের কাজের মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজের ক্ষমতায়িত করেছে, তেমনি সমাজে এনে দিয়েছেন অর্থপূর্ণ পরিবর্তন।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মিলনায়তনে তাদের কাজের স্বীকৃতি জানানো হয়।
২০১৭ সাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি দ্য ডেইলি স্টার ও আইপিডিসি ফাইন্যান্স পিএলসির যৌথ উদ্যোগের এই আয়োজনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করা তৃণমূলের ৪২ জন নারীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের এই অবদান প্রায়শই থাকে উপেক্ষিত ও সবার নজরের বাইরে।
এ বছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাহস ও শক্তির প্রতীক।
পুরস্কার প্রাপ্তরা হলেন বগুড়ার কৃষি উদ্যোক্তা মোছা. সুরাইয়া ফারহানা রেশমা; বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির খেয়াং নারীদের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ হ্লাক্রয়প্রু খেয়াং; পরিবেশবান্ধব কলম প্রস্তুতকারী যশোরের নাসিমা আক্তার; দেশীয় বীজ সংরক্ষণকারী সাতক্ষীরার আল্পনা রানী মিস্ত্রী এবং পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন ও রোগ কমার ক্ষেত্রে অবদান রাখা টিটু পাল।
আইপিডিসি ফাইন্যান্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিজওয়ান দাউদ শামস তার বক্তৃতায় বলেন, 'অদম্য নারীদের অবদান তুলে ধরার জন্য ২০১৭ সালে দ্য ডেইলি স্টার ও আইপিডিসি এই যাত্রা শুরু করেছিল। এই নারীদের জীবনের গল্প যেন এক একটি উপন্যাস। তাদের সংগ্রাম, সাহস ও অন্যদের সাহায্য করার প্রচেষ্টা সবার জানা উচিৎ এবং এগুলো প্রচার করা উচিত। এই ধরনের ইতিবাচক গল্প সামগ্রিকভাবে দেশের অগ্রগতির চাবিকাঠি।'
'আনসাং উইমেন নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ডস'র ষষ্ঠ সংস্করণের বিজয়ী জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়ার স্মরণে অনুষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতা পালনের অনুরোধ জানান রিজওয়ান দাউদ শামস।
মহুয়া জন্ম থেকে হাঁটতে, হাত নাড়াতে বা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু, তিনি সব প্রতিকূলতাকে জয় করে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছিলেন। অক্ষমতা সত্ত্বেও মহুয়া তার পড়াশুনা শেষ করে এমব্রয়ডারি প্রশিক্ষণ নিয়ে ই-কমার্স শুরু করেছিলেন। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তিনি তৈরি করে গেছেন একটি অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ।
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম তার স্বাগত বক্তব্যে নারীদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তারা জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন, যা পুরুষশাসিত সমাজে প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়।
তিনি বলেন, 'এই আনসাং উইমেন নেশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে নারীরা কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সমাজ বদলে দিচ্ছেন, তাদের সম্মানিত করি। আমরা তাদের সামাজিক সচেতনতা, দেশপ্রেম, কঠোর সংগ্রাম ও আত্মবিশ্বাস দেখে আনন্দিত, গর্বিত ও অনুপ্রাণিত।'
মাহফুজ আনাম নারীদের সহনশীলতার প্রশংসা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ব্যাংক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কোনো সহায়তা ছাড়াই কেবলমাত্র নিজেদের ইচ্ছাশক্তির জোরে অগ্রসর হয়েছেন এবং সফলতাও পেয়েছেন।
তিনি বলেন, 'এই কীর্তিমান নারীদের স্বীকৃতি দিতে পেরে আমরা সত্যিই সম্মানিত।'
দাম্পত্য জীবনে নির্যাতিত হয়েছেন রেশমা। সেই সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলেন তিনি।
শুরুতে একটি ছোট মাছের খামার গড়ে তোলেন রেশমা। তারপরে ধীরে ধীরে জৈব সার তৈরি, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন এবং সবজি চাষ শুরু করেন।
সীমিত আর্থিক সংস্থান এবং কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও দৃঢ় সংকল্প ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি।
বর্তমানে তার মাসিক আয় দুই লাখ টাকার বেশি এবং মোট সম্পদ প্রায় দুই কোটি টাকা। তিনি হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণা ও আশার উৎস। তিনি প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজের খামারে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেন।
রেসমার মতোই বাকি পুরস্কার বিজয়ীরাও তাদের সম্প্রদায়ের নারীদের জীবনমান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
হ্লাক্রয়প্রু খেয়াং রাঙামাটি ও বান্দরবানের সুবিধাবঞ্চিত খেয়াং নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করেছেন। এই নারীরা এখন তাদের পরিবার চালানোর পাশাপাশি ভাইবোনদের পড়াশুনা করাচ্ছেন।
গুঙ্গুরু পাড়া আদিবাসী নারী উন্নয়ন সংস্থার সাবেক চেয়ারপারসন এবং বর্তমান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি অনেকের বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন, কৃষিকাজের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েছেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ করতে না পারা নাসিমা পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম তৈরি করেন। এই কলম ব্যবহারের পর মাটিতে পুতে দিলে সেখান থেকে জন্মাবে গাছ। একই সঙ্গে এটি কাগজের হওয়ায় কমছে প্লাস্টিক বর্জ্য।
তিনি এখন সপ্তাহে ছয় হাজার কলম তৈরি করেন এবং এর মাধ্যমে ২০ জন স্থানীয় নারীর কর্মস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।
২০০৫ সাল থেকে আল্পনা তার বীজ ব্যাংকে দেশীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ করে আসছেন। সেখানে এখন ২৫০ ধরনের শাকসবজি এবং ঔষধি গাছ রয়েছে।
তিনি স্থানীয় কৃষকদের বীজ দেন, নারী কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন এবং প্রতি মৌসুমে ৩০০ পরিবারে বীজ বিতরণ করেন।
কক্সবাজারের ডুলাহাজরা ইউনিয়নের টিটু পাল গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজননে পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে দিয়েছেন। তিনি উন্নত মানের গবাদি পশু প্রজনন করছেন এবং গবাদি পশুর রোগ কমিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি ৪০০ গবাদি পশুর প্রজনন করিয়েছেন এবং টিকা দিয়েছেন সাত হাজারের বেশি টিকা দিয়েছেন গবাদি পশুকে। এই আয় দিয়েই তিনি তার সংসার চালান।
এবারের আয়োজনের বিশেষত্ব ছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচ নারী সমন্বয়কের উপস্থিতি।
বিগত বছরগুলোর মতো এবারের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কোনো প্রধান অতিথি ছিলেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও আইপিডিসি ফাইন্যান্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে এই কীর্তিমান নারীদের হাতে ক্রেস্ট ও দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক উমামা ফাতিমা, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজিফা জান্নাত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপসী দে প্রাপ্তি, মোফাজ্জল মোমেনা চাকলাদার মহিলা ডিগ্রি কলেজের তনিমা এবং ভিকারুননিসা নূন কলেজের আসফিয়া রহমানের হাতে স্মৃতি স্মারক তুলে দেন মাহফুজ আনাম ও রিজওয়ান দাউদ শামস।
উমামা বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের সফলতা এখনও উদযাপন করা হয়নি। কারণ, দেশ একটি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। সরকার শহীদদের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনেক আহত শিক্ষার্থী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। অনেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তাদের কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং পুনর্বাসন প্রয়োজন। এই পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে।'
তিনি এই পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করতে সচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এর মাধ্যমে জাতির প্রতি তাদের দায়িত্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ পরিশোধ করতে পারবে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্য সমন্বয়করাও বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কণ্ঠশিল্পী ও সাংবাদিক এলিটা করিম।
এ বছর ১০০টিরও বেশি মনোনয়ন জমা পরে। সেখানে উঠে এসেছে, সারা দেশে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের অবদান কতটা প্রভাব ফেলছে।
Comments