বন্যায় বদলে যাওয়া কহুয়া

হাঁটু পানি ভেঙে বাড়ি ফিরছেন কহুয়ার এক বাসিন্দা। ছবি: স্টার

কহুয়া নদীর পাড়ে গ্রামটির নামও কহুয়া। নদীর নামেই গ্রাম। পরশুরামের বক্স মাহমুদ ইউনিয়নের অন্তর্গত প্রত্যন্ত এই গ্রামটির দুদিকেই নদী। নদীর ওপাড়ে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন।

নদী থেকে পাঁচ কিলোমিটার আগেই পাকা রাস্তা শেষ। এরপর নদী পর্যন্ত পুরোটাই কাঁচা পথ। বন্যায় ফেনী জেলার যে কয়টি গ্রাম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে কহুয়া অন্যতম। এরই মধ্যে ফেনীর বেশিরভাগ এলাকাতে বন্যার পানি নেমে গেলেও কহুয়া গ্রামের বন্যার পানি এখনো নামেনি। রাস্তায় কোথাও গোড়ালি সমান, কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর সমান পানি। ফসলের খেত সবই পানিতে ডুবে আছে।

গ্রামের ফসলী জমিগুলো বন্যার পানির নিচে। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানির তীব্র স্রোত বয়ে গিয়েছে গ্রামটির ওপর দিয়ে। নদী তীরবর্তী গ্রামটির প্রায় সব বাড়িতেই তাই স্রোতের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। গ্রামে ঢুকতেই গ্রামের বাসিন্দাদের কয়েকজন বাঁশঝাড় দেখিয়ে বললেন, বন্যায় গ্রামে দুই মানুষ সমান পানি উঠেছিল।

পথের হাঁটু পানি ডিঙ্গিয়ে আমরা প্রথমেই কহুয়া রাজারখিলের পশ্চিম পাড়ায় যাই। দেখেই এগিয়ে আসেন গৃহকর্তা শামসুল হক ও গৃহকর্ত্রী মানিক বিয়া।

দুজনই জানালেন, নদীতে এখন জাল ফেললেই মাছ ওঠে। কিন্তু মাছ খেতে তো সঙ্গে ভাত লাগবে। সেই ভাতের চালই এখন তাদের ঘরে নেই। অবশ্য তাদের বাড়ি কিছুটা উঁচু হওয়ায় বাড়িতে থাকা পানি নেমে গেছে। একদিন আগেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে এসেছেন মানিক বিয়া ও পরিবারের সদস্যরা। চালের কথা উঠতেই হতাশা আর আফসোস ঝরে মানিক বিয়ার কণ্ঠে।

এবারের ভয়াবহ বন্যার বর্ণনা দিচ্ছিলেন গ্রামের মানিক বিয়া। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

বন্যার কঠিন বাস্তবতার কথা বলতে গিয়ে তারা বলেন, 'কাইললা স্কুলের থুন বাড়িত আইছিলাম। গোলা ঘরেত যাই চাই বেকগান হচি রইছে। (গোলাঘরে গিয়ে দেখি সব পচে আছে) এক সপ্তাহ আগে দুই বস্তা চাইল চুরাইছিলাম। (এক সপ্তাহ আগে ধান থেকে দুই বস্তা চাল তৈরি করেছিলাম।) তিন ড্রাম ধান আছিল। হানিত্তে বেক হচি গেছে। যা আছিল বেক গাংয়েরতে যাই হালাইছি (পানি ঢুকে সব পচে গেছে। পরে সব নদীতে ফেলে দিই)। আর অন চাইলের লে কান্দিয়ের (আর এখন কিনা চালের জন্য কাঁদছি)।'

শামসুল হক ঘরের চারদিক দেখিয়ে বললেন, 'টোডা তলক হানি উইঠছিলো। আন্ডা যে ক্যামনে বার অইছি আর কেমনে স্কুলে যাই উইঠছি বুজোন যাইতো ন (গলা পর্যন্ত পানি উঠেছিল। আমরা কীভাবে যে বের হয়ে স্কুল পর্যন্ত গিয়েছি সেই পরিস্থিতি বোঝানো যাবে না)।'

শামসুল হক আক্ষেপের গলায় আরও বলেন, 'খালি ঘরের ধান চাইল ন। ঘরের খেতা বালিশ, কম্বল, বিছানাপত্র যা আছিল সব ভিজছে। কিছু বাকি নাই। খেত কৃষি কইরতাম। বেক খেত পানিত ভাসি গেছে। সামনে কেমনে চইলব কি করমু খোদায় জানে। সামনে যে খামু এই ব্যবস্থা নাই। কৃষি কাজ কইরতাম, সেই খেত ও অন পানির তলে।'

মানিক বিয়ার পুত্রবধূ পাশেই মাছ কাটছিলেন। বলেন, 'স্কুলে থাকনের সময় তো খিচুড়ি খাই কোনমতে রইছিলাম। অন ক্যামনে চলমু চিন্তা করলেই গায়ে কাঁপন ধরে।'

বন্যার পানি ঘরের কতটুকু উঠেছিল তাই দেখাচ্ছেন। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

গ্রামের বাসিন্দা সকিনা আক্তারের ভিটে জমি থাকলেও ঘর ছিল না। ২০১৯ সালে উপজেলা থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে একটা টিনের ঘর পেয়েছিলেন সকিনা। অভাব থাকলেও হাঁস-মোরগ লালন পালন সে অভাব ঘুচিয়ে কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখছিলেন তিনি।

তিনশর মতো মুরগি আর ১০টি হাঁস ছিল সকিনার। বন্যার পরে এখন মাত্র ১০/১২টি মোরগ টিকে আছে। সকিনার মুরগি যেগুলো বাঁচতে পেরেছে সেগুলো এখন গাছের ডালে ডালে ঘুরছে। বাকি সব স্রোতের টানে ভেসে গেছে। সকিনা নিজে প্রাণে বাঁচতে পারলেও হারিয়েছেন উপার্জনের সব সম্বল।

বন্যার পানি বাড়ায় রাতের অন্ধকারে এক কাপড়েই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সকিনা। আশ্রয়কেন্দ্রে এক সপ্তাহ থাকার পরে দুদিন আগে বাড়ি ফিরলেও এখনো তার গায়ে সেই একই কাপড়।

সকিনা বেগমের মেয়ে পারভীন আক্তার ঘরের ভেজা জিনিসপত্র দেখিয়ে বলেন, 'যা কাপড় আছিল সব কাদা আর পানিতে শেষ। ফেলে দেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। বিছানাপত্র, তোশক বালিশ সর্বত্রই কাদা পানিতে সয়লাব। পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে ফ্রিজ। বাড়ি আসার পর দুইদিন শুধু কাদাই সাফ করছি। যত সাফ করি কাদা আর যায় না।

পানি কমতে থাকায় বাড়ি ফিরছেন গ্রামবাসী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

দুজনই বলেন, 'আমাদের ঘর ভিটে বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে তিন ফুট ওপরে হওয়ার পরেও এই অবস্থা। গ্রামের বাকি মানুষের তাইলে কী অবস্থা হইছে চিন্তা করেন।'

তাদের কথার সত্যতা পাওয়া যায় কহুয়ার সর্বত্র। কহুয়ার পশ্চিম ও পূর্বের পাড়াগুলোতে গিয়ে দেখা যায় সেখানকার মানুষ এখনো বাড়ি ফিরে আসেননি। বাড়ির ভিটেতে পানি।

কহুয়া গ্রামবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগই এখনো আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরেননি। দক্ষিণ পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় সেখান ১২/১৩টি পরিবারের বাস ছিল। এদের কেউই তখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরে আসেননি।

গ্রামের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা যায়, ঘরগুলোর কোথাও টিনের সীমানা প্রাচীর ভেঙে পড়েছে। কোথাও গাছ উপড়ে পড়ে আছে। কোথাও স্রোতের সঙ্গে ভেঙে যাওয়া দরজা পড়ে আছে গাছের সঙ্গে। চারদিকে লণ্ডভণ্ড পরিবেশ জানান দিচ্ছে দুর্যোগের ভয়াবহতা।

সর্বত্র পৌঁছায়নি ত্রাণ, বাড়ি ফিরতে অনাগ্রহ

জেলা শহর ফেনী থেকে অন্তত ৩২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান কহুয়ার। বক্স মাহমুদ ইউনিয়নের বাজার থেকেও গ্রামটির দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। প্রান্তিক গ্রামটিতে বন্যার দশ দিনেও ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। স্বেচ্ছাসেবকেরা অন্যত্র ত্রাণ দিলেও দুর্গম হওয়ায় এই গ্রামে যাননি বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। ফলে কেউ কেউ বাড়ি ফিরে এলেও খাদ্যের অভাবে ফের আশ্রয়কেন্দ্রে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

এদিকে পানি নেমে যাওয়ায় অন্য গ্রামের বাসিন্দারা বাড়ি ফিরে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রেও ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে স্বেচ্ছাসেবকরা অন্য গ্রামগুলোতে ত্রাণ দিচ্ছেন। এতে উভয় সংকটে পড়েছেন কহুয়ার বাসিন্দারা। অবশ্য গত শুক্রবার স্বল্প পরিসরে কহুয়ার কিছু গ্রামবাসীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে গ্রামটির বাসিন্দাদের তুলনায় সে ত্রাণের পরিমাণ ছিল কম।

কহুয়া গ্রামের পথগুলোও বন্যার পানির নিচে। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

গ্রামবাসী মোহাম্মদ শাহাদাৎ তাই আক্ষেপের গলায় বললেন, 'এমুই কেউ ঢুকে না। আমগো গেরাম ভিতরে অনে কেও আইয়ে না। বেশিরভাগ বাইত তো অনো পানি নামেন। যেতারা আইছে হেতারাও না খাই তো আর থাইকতে হাইত্তোন। তাই চলি গেছে। কেউগা আত্মীয় স্বজনের বাইত কেউ আশ্রয়কেন্দ্রত কোনরমে রইছে।' (আমাদের গ্রাম ভিতরে হওয়ায় কেউ আসেনা। বাড়ি থেকে পানি তো সরেনি। যারা বাড়ি ফিরেছে তারা তো আর না খেয়ে থাকতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে কেউ আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে, কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আবার চলে গিয়ে কোনরকমে থাকছে।)

সব হারিয়েছেন কহুয়ার কৃষক ও খামারিরা

কহুয়ার প্রায় বেশিরভাগ বাসিন্দাই কৃষিজীবী। গ্রামের সবখানেই ফসলি ক্ষেতের জমি আর বিল। এসব জমিতে বর্ষা মৌসুমে কোনো ফসল না হলেও, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ধানের জন্য বীজতলা বুনেন কৃষকেরা। কহুয়ার বেশিরভাগ কৃষকেরই ধানের বীজতলা ও ধানের চারা স্রোতের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বীজতলা নষ্ট হওয়ায় নতুন করে বীজতলা তৈরির আশা নেই। ধার নিয়ে যদি ধান চারা কেনেন ও তাহলেও কীভাবে মৌসুম ধরবেন তা নিয়েও রয়েছে বড় আশঙ্কা।

গ্রামের কৃষক আবদুল জলিল বলেন, 'কনকতে হানি নাইমবো আল্লায় এনা জানে। মুইর চাইতো মনে অর আরও দুই মাস ও লাইগদো হারে। ঢলের আগাদি হাচ আজার টেয়া লই জালা বুইনছিলাম। এক হপ্তাহ বাদে আমনের রোয়া লাগাইতাম। ঢলে বেক ভাসাই লই গেছে। (কোন সময় পানি নামবে আল্লাহ জানে। গভীরতা দেখে তো মনে হচ্ছে পানি নামতে আরও দুইমাস ও লাগতে পারে। বন্যার আগে পাঁচ হাজার হাজার টাকা খরচ করে বীজতলা বুনেছিলাম। এক সপ্তাহ পর চারা রোপণ করতাম। সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল।)'

বন্যায় কৃষক এখলাস উদ্দিনের নষ্ট হয়েছে দেড় বিঘা জমির সবজি। তিনি বলেন, 'ধান বাদ দি এবার বেগুন, কদু লাগাইছিলাম। ঢলের লগে বেক চলি গেছে। অন হারা বছর কেন্নে চলমু! ক্যামনে খোরাকি আইবো, জানি না।' (বন্যা সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছে। এখন সারা বছর কীভাবে চলবো জানিনা। কীভাবে উপার্জন হবে জানি না)।

একসময় দিনমজুরি করলেও মাছের খামারের মাধ্যমে কয়েক বছরে অনেকটাই নিজের ভাগ্যবদল করেছিলেন গ্রামের বাসিন্দা ইয়াকুব। পুকুরে মাছ চাষ করে গত এক বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা উপার্জন করেছিলেন তিনি। গ্রামের আটটা পুকুরে প্রায় ১৪ লাখ টাকা লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ইয়াকুব। বন্যায় তার সবগুলো পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। পুঁজি হারিয়ে এখন পুরোপুরি দিশেহারা তিনি। ইয়াকুব বলেন, 'নিজের বেক টেয়া তো পুকুরে ঢাইলছিই। মাছের লাই মাইনসের থুন দুই লাখ টাকা ধার কইরছিলাম। পুকুরের মাছ বেক ভাসি গেছে। মাছের কয়েক বস্তা খানা অনো ঘরে আছে। নিজের টেয়া তো গেছেই, মাইনসের থুন তো যে দেনা কইচ্ছি হেগুন ক্যামনে যে শোধ করমু এই চিন্তায় আছি। বন্যাত ফকির হই গেলাম।'

বিকল্প উপার্জনের চেষ্টা

পেতে রাখা জাল থেকে মাছ ধরছেন গ্রামের একজন। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

একসময় কহুয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই মৎস্যজীবী ছিলেন। গত কয়েক বছরে নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় সেই মৎস্যজীবীরা জীবিকা উপার্জনের তাগিদে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে বন্যা পরিস্থিতিতে কিছু সময়ের জন্য তাদের আগের পেশায় ফিরে এসেছেন তারা। বন্যার পানিতেই জাল বসিয়ে মাছ শিকার করছেন।

এদিকে বাজারেও পড়ে গেছে মাছের দাম। ফলে খোরাকির কিছুটা বন্দোবস্ত হলেও জলের দরেই বিকোচ্ছে মাছ। সন্ধ্যাবেলায় বক্স মাহমুদ বাজার থেকে চাল আর তেল নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন হেদায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, 'বেকে মিলি ছ কেজি মাছ হাইছিলাম। দুইশো টেয়া যাই বেচছি। তাও লইতো চায় না মানুষে। (সবমিলিয়ে ছয় কেজি মাছ ধরেছিলাম। ২০০ টাকায় বিক্রি করলাম। তাও মানুষ নিতে চায় না)।'

Comments

The Daily Star  | English
Impact of dollar crisis

As dollar jumps, old inflation battle to get tougher in new year

After a four-month lull, US dollar prices made an abrupt jump in December, making imports more expensive and pushing up business costs.

11h ago