আগের স্বৈরাচারী সরকারের চর্চা চলমান থাকলে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হবে না: তানজীমউদ্দিন খান
একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভরসাস্থল। তার কাছ থেকেই অনুপ্রেরণা নেন শিক্ষার্থীরা। অতীতে শিক্ষার্থীবান্ধব এমন বহু শিক্ষকের পদচারণায় ক্যাম্পাসগুলো মুখরিত থাকলেও বর্তমানে তা অপ্রতুল।
যেকোনো প্রয়োজন, ন্যায্যতার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে যে গুটিকয়েক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের পক্ষে ঢাল হিসেবে অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান অন্যতম।
ছাত্র-জনতার 'জুলাই অভ্যুত্থান' তথা সরকার পতনের আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। প্ল্যাটফর্মটির হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ এবং সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংকট-সমস্যা, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ ও রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে সবসময় সোচ্চার এই শিক্ষকের সঙ্গে সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়। তার সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, রাষ্ট্র সংস্কার ও অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক।
দ্য ডেইলি স্টার: ছাত্র-জনতার এ আন্দোলন কেন ইতিহাসের পাতায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে? আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: আমার মনে হয় এ আন্দোলনকে সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ নেই। এর প্রেক্ষাপট নতুন, নিরাপদ সড়ক থেকে কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র মেরামত আন্দোলনের রূপ একটু অন্যভাবে বিবেচনা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে আমরা সবসময় নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। ২০১৮ সালে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আন্দোলনের একপর্যায়ে যখন শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হতে শুরু করলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পাশে দাঁড়ায়।
এই আন্দোলনটি অন্যান্য আন্দোলন থেকে ব্যতিক্রম এই অর্থে যে এটা কোনো শীর্ষ নেতৃত্বকে ঘিরে বিকশিত হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এটি হয়নি। একটি ডিসেন্ট্রালাইজড লিডারশিপের মাধ্যমে সব মতামতের, মতাদর্শের—সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে, এমনকি অনেক ছাত্রলীগকর্মীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
আন্দোলনটি শুরুতে একেবারেই কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল এবং শান্তিপূর্ণ ছিল। এর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সমন্বয়ক, যারা একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই শুরু করেছিল। তাদের ভিন্ন মতাদর্শিক পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু তার বাইরে এসে রাজনৈতিক ফোর্স, ব্যানার না থাকায় এই প্লাটফর্ম সবার জন্য একটি স্পেস তৈরি করেছিল, যেটি কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি করতে পারছিল না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা। আর এর সঙ্গে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ঘিরে আগেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হয়েছে, পরে সেটা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ফলে এ আন্দোলন দমানোর জন্য যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার প্রচণ্ড আগ্রাসী হলো, ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ব্যবহার করা হলো, তখন ওই বন্ধন বা সলিডারিটির অংশ হিসেবে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরাও রাস্তায় নেমে এসেছে, যেটি ছিল হিসাবের বাইরে। আমি নিশ্চিত যে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকার—কেউই এ হিসাবটি করেনি। কারণ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের কোটা সংস্কার, কিংবা সরকারি চাকরি নিয়ে আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু তাদের সলিডারিটি বা বন্ধুত্ব সেটি অন্যতম একটি প্রেক্ষাপট। অতীতে তাদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা এই রেজিস্টেন্স তৈরি করেছে।
আবার যখন ছয় সমন্বয়কদের তুলে নিল ডিবি, ভাবা হলো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল সহ-সমন্বয়করা নিজেদের মতো করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ডিবি অফিস থেকে যখন আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দেওয়ানো হলো, তখন তার বিপরীতে অন্যরা চলে এলো নয় দফা দাবি নিয়ে।
অন্যদিকে ঘরের ভেতরেও যখন শিশুসহ অনেকে গুলিবিদ্ধ হলো, মারা গেল, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হলো—তখন প্রতিটি মানুষ নিজেকে অনিরাপদ ভাবতে শুরু করল। এরপর হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ব্লকরেইড দেওয়া, এত নৃশংসতা—এসব ভাবনা সবার মধ্যে সেন্স অব ইউনিটি তৈরি করল। সবাই ভাবল এ রেজিম সরাতে না পারলে আমরা কেউই নিরাপদ না এবং সবকিছু মিলিয়ে আন্দোলনটি চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছালো। যার ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং শ্রমজীবী—সবাই এক কাতারে চলে আসে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেখলাম ডিওএইচএসে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম হলেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি—মানে কেউ যদি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে বিএনপি-জামায়াত বলা, আবার কেউ যদি বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে আওয়ামী লীগ বলার চর্চা এখানে ছিল। কিন্তু এ আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি না থাকায় সেন্স অব ইউনিটি তৈরিতে ট্যাগিংয়ের ওই রাজনীতিকে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।
৫৩ বছরের যে জঞ্জালের রাজনীতি, যা সব মানুষের স্বার্থ রক্ষা না করে গুটিকয় মানুষের স্বার্থ দেখে, ওই রাজনৈতিক কাঠামোতে মানুষ আর ফিরে যেতে চায় না। অন্তত আমি মনে করি মূল ধারার দলগুলোর কর্মী ছাড়া সবাই এর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং আমরাও মনে করছি এটিই মোক্ষম সময় পেছনের এ জঞ্জালে ফিরে না যাওয়ার। স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের দ্বিতীয় পর্ব তৈরি হয়েছে।
ডেইলি স্টার: আন্দোলনে শিক্ষক নেটওয়ার্কের একটা ভূমিকা ছিল। রাষ্ট্র গঠনে বা সংস্কারে তাদের করণীয় কী হবে?
তানজীমউদ্দিন খান: আমরা যেহেতু অ্যাকাডেমিক, আমাদের মূল জায়গাটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা আমরা যেরকম চাই, সেরকম দেখতে চাইলে বলতে হবে রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা বা আমরা যে আকাঙ্ক্ষার কথা বলি সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব না। এ কারণে শিক্ষক নেটওয়ার্কের যে কাজগুলো আমরা করে এসেছি তা আমরা ধারাবাহিকভাবেই করব।
রাষ্ট্র আগে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় আর দেখতে চাই না। এখন যদি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্ক প্রস্তুত তা করার জন্য।
ডেইলি স্টার: অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আপনাদের কী প্রত্যাশা এবং আপনাদের বক্তব্য তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি?
তানজীমউদ্দিন খান: শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগের আগেই ৩ তারিখে আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা এবং পদত্যাগের পর বিকল্প কেমন হতে পারে, সেগুলো জানিয়েছি। আমরা সরাসরি এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে যুক্ত না। কিন্তু এ আন্দোলনে যেহেতু শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভূমিকা আছে, সেই হিসেবে আমরা ভাবনাগুলো তুলে ধলার চেষ্টা করছি। তবে বাস্তবায়ন সরকারের বিষয়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত, রাষ্ট্রের কী ধরনের পরিবর্তন, সংবিধানের পরিবর্তন হওয়া উচিত কি না, বা নতুন সংবিধান আসা উচিত কি না—এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের শিক্ষক নেটওয়ার্কের যে প্রতিশ্রুতিগুলো আছে, আমরা সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।
ডেইলি স্টার: সরকারের কার্যক্রমে আপনারা কেমন ভূমিকা রাখতে পারেন?
তানজীমউদ্দিন খান: আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা আছে যারা সরকারে আছে তাদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। তাদের অভিজ্ঞতাগুলোও আমরা জানব। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা আমাদের বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে বুঝছে কি না। এখন যে নতুন বাস্তবতা, এটি খুব জটিল। সেক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত কি না, নাকি ক্ষমতার সেই সনাতনী রাজনীতির ঘেরাটোপে পড়ে যাবে এর ওপর নির্ভর করছে সবকিছু।
আগের সরকারের মতো গতানুগতিক হলে হবে না। এই পরিস্থিতিতে খুবই সৃজনশীল হতে হবে। না হলে পরিস্থিতি সামলানো যাবে না। এর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে সরকারে থাকা ব্যক্তিদের দলগত কাজের মানসিকতা। অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য কী, উপদেষ্টারা সবাই লক্ষ্যের প্রতি একইভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কি না। আমার মনে হচ্ছে এ বিষয়ে আমরা কোনো পরিষ্কার ধারণা পাচ্ছি না। তাদের কর্মপরিকল্পনা কী, কোন সংস্কারগুলোকে তারা অগ্রাধিকার দিবেন, বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা ও শিক্ষাব্যবস্থা। সংখ্যালঘুদের বিষয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ অতিরিক্ত সংবেদনশীল। এ বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। বাইরে বৈধ-অবৈধ অস্ত্র আছে, এগুলো যদি উদ্ধার না করা যায়, তাহলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এটিকে সবার আগে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এখনো যেভাবে মব জাস্টিসের একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে, দলে দলে গিয়ে অফিসে ঢুকে যাচ্ছে, সচিবালয়ে ঢুকে যাচ্ছে দাবি হোক যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক, মব জাস্টিসের প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে না নতুন বাংলাদেশ, মনে হচ্ছে আগের মতোই পুরোনো বাংলাদেশে আছি। আবার দেখা যাচ্ছে আগের রেজিমের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। চিহ্নিত ব্যক্তিদের অপরাধও চিহ্নিত। সুনির্দিষ্ট মামলার ভিত্তিতেই তাদের জেলে নেওয়া যায়। গাড়ি ভাঙার মামলা দিয়ে তো তাদের জেলে ঢোকানোর কিছু নেই। আগের স্বৈরাচারী সরকারের একই চর্চা যদি আমরা করি, তাহলে তো নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করতে পারব না।
এই সরকার যে আগের সরকার থেকে আলাদা, সেটা প্রতি পদে চিহ্ন রেখে যেতে হবে, প্রতি পদে তা প্রমাণ করতে হবে। আমরা এখন পর্যন্ত তা দেখছি না। এসব ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সরকারের অগ্রাধিকার, কর্ম পরিকল্পনা, লক্ষ্য যদি সুস্পষ্ট না করা যায়, তাহলে টিমওয়ার্কও সুস্পষ্ট হয় না এবং এগুলোকে অবশ্যই পাবলিক করতে হবে। যেহেতু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে তারা এসেছেন, তাদের কোনোকিছু লুকিয়ে করার উপায় নেই। জনগণ যদি তাদের আস্থায় না নেয়, তাহলে তো সনাতনী রাজনৈতিক দলের মতোই হয়ে যাবে। জনগণকে আস্থায় নিতে হবে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা এখন খুব এলোমেলো অবস্থায় আছি। এরকম পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ তৈরি হওয়া। এর প্রধান মাধ্যম হতে পারে তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে জাতির উদ্দেশে বক্তব্যের মাধ্যমে নিশ্চিত করা এবং এটি সময়ে সময়ে করা। উনারা কী করলেন, কী অর্জন, কী করতে পারছেন, কী করতে পারছেন না—সেগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর জাতিকে জানানো। তাহলে আস্থাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে।
ডেইলি স্টার: কেমন দেশ চান?
তানজীমউদ্দিন খান: বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। চেতনাটি একটি দলের দখলে চলে গিয়েছিল। ওই চেতনার মালিক যেন বাংলাদেশের সব মানুষ হয়। ধর্ম, বর্ণ বা অন্য যেকোনো বৈশিষ্ট্যই থাকুক না কেন, কেউ কারও বিরুদ্ধে যেন বিদ্বেষ না ছড়ায় তার চর্চা করা। নব্য ফ্যাসিবাদের ধ্বনি থেকে বেরিয়ে সবাই যেন নতুন স্বপ্ন ধারণ করে। নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে একে অন্যকে সহযোগিতা করে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একটি প্রচারণা ছিল যে তারা ক্ষমতায় না থাকলে বাংলাদেশ জিহাদি বা জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে যাবে। এবার আবার ক্ষমতা পরিবর্তনের সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল না দেশের ওপর। এ কারণে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনা যখন ঘটেছে, তখন একটা আলাপ তৈরি হয়েছে যে এই বুঝি জিহাদি রাষ্ট্র হয়ে গেল দেশ।
আমি বলতে চাই, এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সবাই এক হয়েছে। বিভক্তির রাজনীতি আমরা আর চাই না। যেহেতু আমরা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই, সেহেতু সবার অংশগ্রহণের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠন জরুরি। আগের রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। এখানে বহু ধরনের বহু মতাদর্শের মানুষ থাকবে। ক্যালিগ্রাফি থাকবে, ভাস্কর্যও থাকবে। কারণ এখানে কেউ কারো শত্রু না। এটাই বাংলাদেশ। এটাই বাংলাদেশের সৌন্দর্য।
ডেইলি স্টার: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম এতদিন হয়েছে। এসব ঠেকাতে এখন কী করা দরকার?
তানজীমউদ্দিন খান: এখন সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে প্রশাসনিক শূন্যতা। এ কারণে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। খুব দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো স্থিতিশীল করা এবং যোগ্য মানুষদের নেতৃত্বে আনা প্রয়োজন। দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে অ্যাকাডেমিকভাবে কোয়ালিফাইড ও প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন—এ দুয়ের সংমিশ্রণ আছে এমন মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে। যেহেতু এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উপাচার্য নির্বাচন সম্ভব না, সেক্ষেত্রে আচার্য আপৎকালীন সময়ের জন্য যোগ্য মানুষদের নেতৃত্বে আনতে পারেন। স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করলে মব জাস্টিসের প্রবণতা রোধ করা যাবে।
ডেইলি স্টার: দেশের বাইরে থেকে দক্ষ কাউকে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি করা যায় কি না?
তানজীমউদ্দিন খান: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ আমরা দেখেছি। কিন্তু সেটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপট। তাদের বাস্তবতা এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার মধ্যে ভিন্নতা আছে। এখানকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি দেশের কেউ চালাতে না পারে, তাহলে বিদেশের কেউ চালাতে পারবে—তা আমার মনে হয় বুদ্ধিমানের কথা না। যিনি আসবেন তাকে বুঝতে হবে এখানকার রাজনৈতিক কাঠামো বা রাজনৈতিক বাস্তবতা কেমন। এমন কিছু জটিলতা আছে যা প্রচলিত প্রশাসনিক কার্যক্রমের বাইরে। প্রশাসনিকভাবে দক্ষ এমন কাউকে বিদেশ থেকে আনলাম, তিনি যদি দেশের বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপট না বোঝেন, তাহলে সমস্যা পোহাতে হবে।
বিদেশি কেউ এখানকার অবস্থা সামলাতে পারবেন—এটা হয়তো আমরা আস্থাহীনতার জায়গা থেকে বলি। বাংলাদেশের মানুষের যথেষ্ট সামর্থ্য ও সক্ষমতা আছে। আপনি সেই মানুষটিকে চিহ্নিত করতে পারলেন কি না, সেটি মূল প্রশ্ন। আমাদের কৃতিত্ব তখনই, যখন আমরা সঠিক মানুষকে নির্বাচন করতে পারব।
ডেইলি স্টার: আলোচনা উঠেছে যে আমরা ভারতের বলয় থেকে মুক্ত হয়ে এখন মার্কিন বলয়ে ঢুকে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক হিসেবে আপনার অভিমত কী?
তানজীমউদ্দিন খান: বর্তমানে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, সেক্ষেত্রে এ ধরনের কথা যে কেউ বলতেই পারে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক না হয়ে, রেজিমকেন্দ্রিক হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের এক ব্যক্তির ওপর ভর করে ভারত এখানে তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করেছে। শুধু তাই না ভারতের রেজিমের ব্যবসায়ীদের স্বার্থও আমরা রক্ষা করেছি, যার উদাহরণ আদানি। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থ কিছুই নিশ্চিত করতে পারেনি। এর ফলে আমাদের এখানে দুই দেশের রেজিম যেমন অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, একইসঙ্গে তৈরি হয়েছে ভারত-বিরোধিতা। ট্রানজিট, রেল করিডোর কিংবা বর্ডার কিলিং—ইস্যুগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারেনি। এতে আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা এবং তা থেকে ভারত-বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, তাই হয়তো মনে হতে পারে আমরা ভারতের রেজিম থেকে বেরিয়ে এসেছি।
অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন যে রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং চীনের সঙ্গে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেখানে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান একইরকম। কিন্তু গ্লোবাল পলিটিকসে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে নেই। ভারত-রাশিয়া-চীন মেরুকরণ বনাম যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের একটা মেরুকরণ আছে। এমন হিসাব দেখে মনে হতে পারে যে এখানে আমেরিকার প্রভাব বাড়ছে। এটি নির্ভর করছে আগামীতে আমাদের সরকার কীভাবে বিষয়টি সামলায়। তাদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে যে আমরা কোনো বলয়ে ঢুকে যাব, নাকি আমরা দুই মেরুর মাঝে ভারসাম্য রাখব।
ডেইলি স্টার: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সমন্বয়করা। বন্দোবস্তটা কেমন হতে পারে?
তানজীমউদ্দিন খান: নতুন বন্দোবস্তে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রথম কাজই হবে সংবিধান সংস্কার। সংবিধানে এমন কিছু উপাদান আছে যেগুলো খুবই প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক। প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের প্রধান, দলের প্রধান, সংসদের প্রধান, একের মধ্যে তিন। তাহলে তার কোন পদের জবাবদিহিতা কে করবে?
অন্যদিকে পার্লামেন্টের কাজ ক্যাবিনেটকে জবাবদিহির আওতায় আনা। এখন পার্লামেন্টের মেম্বার ক্যাবিনেটে থাকলে তো সেটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। আবার আর্টিকেল ৭০ অনুযায়ী ফ্লোর ক্রস করা যায় না। এই ভারসাম্যগুলো না থাকায় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
আবার দলের মধ্যেও গণতান্ত্রিক ধারা গড়ে ওঠেনি। আমরা একজনকেই দেখছি বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকতে কিংবা তার অনুগতরা পদে থাকছেন। এগুলো যদি পরিবর্তন করতে না পারি, তাহলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।
Comments