চীনের আপেল, দেশের পাতা

ভ্যানভর্তি আপেলের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা পাতাগুলোকে আপেল পাতা ভাবলে ভুল হবে। ফলটা আপেল হলেও পাতাগুলো মেহেগনির।
পণ্যের তথ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক পোর্টাল ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষ প্রতিদিন গড়ে পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার কেজি আপেল খায়। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

ভ্যানভর্তি আপেলের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা পাতাগুলোকে আপেল পাতা ভাবলে ভুল হবে। ফলটা আপেল হলেও পাতাগুলো মেহেগনির।

ভ্যানের সঙ্গে থাকা দুই ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা বলছেন, পাতা ছাড়া আপেল দেখতে কেমন যেন লাগে! তাই ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে আপেলের ওপর অন্য পাতা সাজিয়ে রেখেছেন তারা। তাদের ভাষায় এটা তারা করেছেন 'ডিসপেলের' (ডিসপ্লে) জন্য।

সাধারণত আম, লিচু, জাম, জামরুলসহ বিভিন্ন দেশি ফল বিক্রেতাদের অনেক সময় পাতাসহ ফল সাজিয়ে রাখতে দেখা যায় ক্রেতার আস্থা অর্জনের জন্য। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চান যে, ফলগুলো টাটকা কিংবা সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা।

তবে আনার, আঙুর কিংবা আপেলের মতো বিদেশি ফল যেহেতু পাতাসহ আমদানি হয় না, তাই এগুলোর সাজনদারি সাধারণই হয়। এদিক থেকে আপেলের সঙ্গে অন্য পাতা রেখে বিক্রির এই দৃশ্যটি খানিকটা ব্যতিক্রমই বলতে হবে।  

এই ভ্রাম্যমাণ দোকানে আপেল খেয়ে এর মিষ্টতা পরীক্ষা করে কেনার সুযোগ আছে। ছবি: স্টার

আজ শুক্রবার ছুটির দিনে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের একটি সড়কে এমন চিত্র চোখে পড়ে।

দুই বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চীন থেকে আমদানি করা আপেলগুলো তারা কিনেছেন দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলের বাজার পুরান ঢাকার বাদামতলী থেকে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে খুচরায় প্রতি কেজি আপেল তারা বিক্রি করছেন ২০০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে।

দেখা গেল, এই ভ্রাম্যমাণ দোকানে আপেল খেয়ে এর মিষ্টতা পরীক্ষা করেও কেনার সুযোগ আছে।

স্বাস্থ্যকর ফল হিসেবে আপেলের জনপ্রিয়তা বরাবরই বেশি। বাংলাদেশে বিদেশি ফলের বাজারে সবেচেয় বেশি আধিপত্যও আপেলের। পণ্যের তথ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক পোর্টাল ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য অনুযায়ী, আপেল আমদানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম আর খাওয়ার দিক থেকে ২৫তম। পরিমাণের দিক থেকে যা বছরে এক লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিকটন অর্থাৎ ১৯ কোটি ৫০ লাখ কেজি। সে হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিদিন গড়ে পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার কেজি আপেল খায়।

আপেল খাওয়া এবং উৎপাদন—দুই দিক থেকেই প্রথম স্থানে আছে চীন। আর উৎপাদনের দিক পরের স্থানগুলোতে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।

বাংলাদেশে ডলার সংকটের মধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে সব ধরণের বিদেশি ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরে ফল আমদানিতে ঋণ সুবিধাও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপে থাকায় তখন ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানি ব্যয়ে লাগাম টানার ওপর জোর দেওয়া হয়। তার অংশ হিসেবে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সরকার এই কর আরোপ করে। আর খাদ্য-পণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিদেশি ফলকে বিলাস-পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

ফলে আঙুর, আপেল, কমলা, নাশপাতির মত বিদেশি ফলগুলো বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের অংশ হলেও সেগুলোর আমদানি কমে আসার পাশাপাশি দামও বেড়ে যায়। যে কারণে দুই বছর ধরেই এসব ফলের বাড়তি দর বিস্মিত করছে ক্রেতাদের। খরচ সমন্বয় করতে গিয়ে অনেকে তাই এগুলো কেনা কমিয়েছেন, অথবা বাদ দিয়েছেন।

বাদামতলীর ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ আপেল আমদানি করে প্রধানত দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, চীন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। আর আপেলসহ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশি ফল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি হয় সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বুড়িমারী ও হিলির স্থলবন্দর দিয়ে। এসব স্থান দিয়ে ফল আমদানি করার সময় তিন ধাপে ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তা বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেয় সরকার।

দুনিয়ায় মোট সাড়ে সাত হাজার জাতের আপেল আছে। ছবি: স্টার

বলা হয়ে থাকে, দুনিয়ায় মোট সাড়ে সাত হাজার জাতের আপেল আছে। সে হিসেবে রোজ যদি একটা করে জাত চেখে দেখা হয় তাহলেও ২০ বছর লেগে যাবে।

পৃথিবীজুড়ে নানা রঙের, নানা আকারের আপেলের দেখা মেলে। তবে আপেলের সবচেয়ে পরিচিত তিনটি রং হলো লাল, হলুদ ও সবুজ। তবে বাংলাদেশের বাজারে লাল ও সবুজ আপেলের দেখা মেলে।

বাইবেলের ভাষ্যমতে, স্বর্গের বাগানে (ইডেন) শয়তানের প্ররোচনায় ইভ নিষিদ্ধ এক আপেল তুলে দিয়েছিলেন অ্যাডামের হাতে।  সেই আপেল খেয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসেন তারা।

প্রবাদ আছে, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একটি করে আপেল থাকলে নাকি ডাক্তার থেকে দূরে থাকা যায়। মানে রোগবালাই কম হয়।

চিকিৎসকদের ভাষ্য, মূলত কম পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট আর অধিক পরিমাণ অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও মিনারেল থাকায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশে আপেলের ভীষণ কদর।

মধ্য এশিয়াকে আপেলের উৎপত্তিস্থল বলে ধরা হয়। হাজার বছর ধরে এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে আপেলের চাষ হয়ে আসছে। ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের হাত ধরে লাতিন আমেরিকায় আসে আপেল।

অনেক সংস্কৃতিতে আপেলের ধর্মীয় এবং পৌরাণিক তাৎপর্য আছে। এগুলোর ভেতর নর্স, গ্রিক ও ইউরোপীয় খ্রিষ্টীয় ঐতিহ্য অন্যতম।

Comments

The Daily Star  | English

Gaza rescuers say Israeli forces kill 60, half near aid centres

Civil defence spokesman Mahmud Bassal told AFP that five people were killed while waiting for aid in the southern Gaza Strip and 26 others near a central area known as the Netzarim corridor, an Israeli-controlled strip of land that bisects the Palestinian territory

26m ago