গুনে গুনে ঘুষ নেন সমাজসেবা কার্যালয়ের অফিস সহকারী মমতাজ

অফিস সহকারী বলেন, ভিডিওতে আমাকে টাকা নিতে দেখা যায়নি, গুনতে দেখা গেছে।
ঘুষের টাকা গুনছেন চকরিয়া উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অফিস সহকারী মমতাজ বেগম। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অফিস সহকারী মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ঘুষ নেওয়ার ঘটনার ৬ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

এতে দেখা যায়, নিজ কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মমতাজ বেগম গুনে গুনে ঘুষের টাকা নিচ্ছেন।

অভিযোগ রয়েছে, সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আমজাদ হোসেনের জন্য টাকাগুলো নিচ্ছিলেন মমতাজ।

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, কাউকে কল করে ঘুষের টাকা বুঝে পাওয়ার কথা নিশ্চিত করছেন মমতাজ।

ভিডিওতে দেখা যায়, মমতাজ বেগমের অফিস কক্ষে যান একজন। এ সময় মমতাজ বেগমকে তিনি পকেট থেকে এক হাজার টাকার বেশকিছু নোটের একটি বান্ডিল দেন।
মমতাজ বেগম প্রশ্ন করেন, 'এখানে কত দিয়েছেন?'

টাকা গুনে নিতে বলা হলে মমতাজ বেগম মুখে বলতে বলেন। এরপর তিনি টাকার বান্ডিল হাতে নেন এবং টাকাগুলো গুনতে থাকেন।

টাকা নিয়ে আসা ব্যক্তি মমতাজ বেগমের উদ্দেশে বলেন, 'আমি টাকা তুলতে পারিনি। অনেক কষ্ট করে টাকা এনেছি। প্রথম কিস্তির বরাদ্দ ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা সই না থাকায় তুলতে পারিনি।'

তখন মমতাজ বেগম তাকে বলেন, 'আপনি ঠকে যাবেন। আপনার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।'

মমতাজ বেগমকে তিনি অনুরোধ করে বলেন, 'আমি বেঁচে থাকলে পাবেন।'

'এ টাকা নিলে আমাকে বকা দিবে' জানিয়ে মমতাজ বেগম ফোন কল দিয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তাকে বলেন, 'স্যার, রফিক মেম্বারের ৮০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল, ৪০ হাজার দিয়েছে। স্যার, এক মাস পর আবার বিল আছে, তখন কেটে রাখতে হবে।'

ভিডিওতে ঘুষ দিতে যাকে দেখা যায়, তার নাম রফিকুল ইসলাম বলে জানা গেছে। তিনি হারবাং মধ্যম পহরচাঁদা এতিমখানার সভাপতি ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য।

ঘুষের বিষয়ে ইতোমধ্যে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, সচিব, দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভিক্ষুকদের সেলাই মেশিন দেবে বলে আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিল চকরিয়া সমাজসেবা অফিস। চাঁদা দিতে না পারায় ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এতিমখানা পরিদর্শন করেন কর্মকর্তারা। পরদিন আমি অফিসে যাই।'

'অফিসে কেন এসেছি জানতে চেয়ে তারা আমাকে বকাবকি করেন এবং "জরিপ ও বিলের সময় দেখিয়ে ছাড়ব" বলে হুমকি দেন। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের বিল দাখিল করলে আমাকে তারা বলেন, পরিদর্শন কর্মকর্তা বিল না দিতে বলেছে,' বলেন রফিকুল।

তিনি আরও বলেন, 'সমাজসেবা কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন ও অফিস সহকারী মমতাজ বেগমের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করি। ২০২৩-২৪ সালের প্রথম কিস্তি ১ লাখ ৯২ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা তাদের ঘুষ দিতে হবে। না হলে এতিমখানার টাকা ফেরত পাঠিয়ে দেবে। তাদের কথায় রাজি হয়ে চেক নেই। চলতি মাসের ৮ তারিখ সমাজসেবা অফিসে গিয়ে দুপুর ১২টার দিকে অফিস সহকারী মমতাজ বেগমকে ৪০ হাজার টাকা দেই। এ টাকা গুনে নেওয়ার সময় জানতে চান, বাকি ৪০ হাজার কোথায়? এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে আমজাদ হোসেনকে ফোন করে মমতাজ বেগম বলেন, রফিক মেম্বার আমার সঙ্গে বাটপারি করেছে, দ্বিতীয় কিস্তির সময় ৪০ হাজার টাকা রেখে দেবো।'

লিখিত অভিযোগে বলা হয়, চকরিয়া উপজেলায় সমাজসেবা বিভাগের তালিকাভুক্ত ২৮টি এতিমখানা আছে। সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন এতিমখানা অডিট করতে গেলে ১০ হাজার টাকা নেন। এ টাকা না দিলে অডিট না করেই চলে আসেন।

এতিমখানা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও উপবৃত্তির টাকা তোলার সময় ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ লেনদেন ছাড়াও এ কর্মকর্তা দুর্ব্যবহার করেন সেবাপ্রার্থীদের।

ঘুষ নেওয়ার ভিডিওর বিষয়ে মন্তব্য জানতে মমতাজ বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভিডিওতে আমাকে টাকা নিতে দেখা যায়নি, গুনতে দেখা গেছে। আমার স্বামী বিদেশে থাকেন। তিনি বিকাশে টাকা পাঠিয়েছেন। আমি সেই টাকা গুনছিলাম।'

ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আমজাদ হোসেনকে কল করা হলে তিনি তার অফিসে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, 'অফিসে আসলে আপনাকে বিষয়টি বিস্তারিত বুঝিয়ে বলব। আসলে বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।'

কক্সবাজার জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক হাসান মাসুদ বলেন, 'এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত চলছে। তদন্তে অভিযুক্তরা দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments