নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের এক দশক: হত্যাকারীদের শাস্তির অপেক্ষায় স্বজনরা

হত্যাকাণ্ডের শিকার সাতজন।

মৃত্যুর আগে ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তি দেখে যেতে চান বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী খান। কিন্তু সেটা পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ৮০ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা। হাসপাতালের শয্যায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে এখন হায়দার আলী খানের শেষ চাওয়া হত্যাকারীদের শাস্তি।

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারানোদের মধ্যে একজন হায়দার আলীর ছেলে মনিরুজ্জামান স্বপন। ১০ বছর আগে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (লিংক রোড) থেকে অপহরণের শিকার হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ।

২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত এই মামলার রায়ে সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে যান।

২০১৮ সালের আগস্টে উচ্চ আদালত ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। এরপর আপিল করা হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরেই মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুজ্জামান বুলবুল।

নিহত স্বপনের ভাই ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিজানুর রহমান খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বছর এপ্রিল এলেই ছেলের শোকে কাতর হয়ে পড়েন আমার বৃদ্ধ বাবা-মা। ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ২০ এপ্রিল বাবাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার কথা বলা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। তার কেবল একটাই ইচ্ছা, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তিনি ছেলের হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে—এইটা কথাটা শুনতে চান।'

সাত খুনের মামলাটি আপিল বিভাগ থেকে দ্রুত নিষ্পত্তি করে হত্যাকারীদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার দাবিও জানান তিনি।

সেদিন স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমও খুন হন। সেই সময় তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। জাহাঙ্গীরের ১০ বছর বয়সী কন্যা রোজা বাবার আদর কী তা জানে না। বাবার মৃত্যুর একমাস পর জন্ম নেওয়া রোজার কাছে বাবা মানে কেবল তার পুরোনো ছবি। তা আকড়েই বাবা হারানোর বেদনা প্রশমনের চেষ্টা ছোট্ট এই শিশুও।

'প্রতিরাতে বাবার জন্য কান্না করি। তার একটা ছবি আমি সবসময় সঙ্গে রাখি। যখন ছবিটা দেখি, তখন মনে হয় বাবা আমার সঙ্গেই আছেন', বাবার ছবির ওপর হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল রোজার।

ঘটনার দিন একটি মামলায় হাজিরা শেষে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হয়েছিলেন। তবে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

দীর্ঘ বছরেও এই মামলার আসামিরা শাস্তি না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বলেন, 'মামলাটির রায় হয়ে গেছে, কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে না। অপরাধীরা অনেক প্রভাবশালী। সেই প্রভাবের অপব্যবহার করেই রায় কার্যকর হতে দিচ্ছে না তারা। তবু বিচার বিভাগের ওপর ভরসা করে আছি। যতদিন না রায় কার্যকর হচ্ছে, ততদিন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকব। সাজাপ্রাপ্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় নিহতদের স্বজনরাও এখনো আতঙ্কে থাকেন।'

নজরুলের বড় ছেলে তরিকুল ইসলাম বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় এমএসসি করছেন। ছোট ছেলে জাহিদুল ইসলাম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং একমাত্র মেয়ে নাজিফা ইসলাম একটি মেডিকেল কলেজে পড়ছেন।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নজরুলের স্ত্রী বেলন, 'তাদের বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েরা ভালো জায়গায় পড়াশোনা করবে, জীবনে সফলতা পাবে। তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু সেটা দেখার জন্য লোকটাই বেঁচে নেই।'

হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্য তিনজন হলেন—নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, আইনজীবী চন্দনের ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম।

মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে থাকলেও গত পাঁচ বছরে এর কোনো শুনানি হয়নি জানিয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, 'নারায়ণগঞ্জে বিচারিক আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেছে ২০১৭ সালে। এরপর কয়েকজনের সাজা কমালেও পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর আসামিরা আপিল করলে মামলাটি সেখানে ঝুলে আছে।'

'মামলাটি অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত শুনানি বিষয়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ এটা চায় না। তারা চাইলে দ্রুত শুনানি সম্ভব। এটি একটি ওয়েল প্রুভড কেস। আমরা আশা করি, দেরিতে হলেও এই রায়ই বহাল থাকবে', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

12h ago