একজন রিকশাওয়ালা যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে

একজন রিকশাওয়ালা যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী | ছবি: সংগৃহীত

'তাহলে আবার কী বিলেতেই ফিরে যাব? দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে না পারলে দেশে থেকে লাভ কী?'—১৯৭২ সালে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাবনা।

যে নামে হাসপাতাল করতে চান সেই নামে করা যাবে না, বিদেশ থেকে অর্থ আনতে দেবে না, স্বাধীন দেশের আমলাতন্ত্র প্রতি পদে পদে বাঁধা তৈরি করছে। চূড়ান্ত রকমের হতাশ হয়ে পড়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

ভাবছেন, 'যুদ্ধ করে, এত ত্যাগ স্বীকারে দেশ স্বাধীন করলাম, আর সেই দেশে কাজ করতে পারব না!'

বন্ধুদের অনেকেই আবার বিলেতে ফিরে গেছেন। মন খারাপ নিয়ে ঘুরছেন। একদিন এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথোপকথন:

'রিকশাওয়ালা: স্যার, মনটা খারাপ কেন?

ডা. জাফরুল্লাহ: বিলেত থেকে দেশে ফিরে আসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও হাসপাতাল তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করলাম। কিন্তু স্বাধীন দেশে সেই হাসপাতাল করতে পারছি না। আবার মনে হয় বিলেতে ফিরে যেতে হবে—এ কারণে মন খারাপ।

একজন রিকশাওয়ালা যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল

রিকশাওয়ালা: স্যার, আপনারা না হয় চইলা যাইতে পারবেন। বিলাতের মানুষ বিলাতে চইলা চাইবেন। আমরা তো যাইতে পারব না। আমাদের কী হবে? আমগো কথা ভাববেন না?'

ডা. জাফরুল্লাহর ভাষ্য, 'রিকশাওয়ালার এই কথা আমাকে খুব বড়ভাবে নাড়া দিলো। তাহলে আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি? নিজের ভেতরে প্রশ্ন তৈরি করে দিলেন রিকশাওয়ালা।'

নিজেকে যেন আবার ফিরে পেলেন ডা. জাফরুল্লাহ। বিলেতে ফিরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে আবার কাজে মনোযোগী হলেন। দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'বড় বড় হাসপাতাল বানাতে হবে।' ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বললেন, 'না মুজিব ভাই, বড় হাসপাতাল না, শুরু করতে হবে গ্রাম থেকে। গ্রামের মানুষ না জাগলে বাংলাদেশ জাগবে না।'

একজন রিকশাওয়ালা যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

বঙ্গবন্ধু তার কথা শুনে চুপ করে থাকলেন। হয়তো তারও ভাবনায় পরিবর্তন এলো।

'মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে যে "বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল" করেছিলাম, সেটা এখন সাভারে করতে চাই। কিন্তু এই নামে হাসপাতাল করতে দিচ্ছে না আমলারা', বললেন ডা. জাফরুল্লাহ।

বঙ্গবন্ধু বললেন, 'এটা কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। তুই অন্য নাম ঠিক কর।'

নাম নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। 'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের ইমোশন জড়িত,' বললেন বঙ্গবন্ধুকে।

তাতেও রাজি হলেন না বঙ্গবন্ধু। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বললেন, 'এক কাজ কর, তুই তিনটা নাম ঠিক কর, আমি তিনটা নাম ঠিক করি। তারপর আরেক দিন আয়।'

তিনটি নাম ঠিক করে কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধু বললেন, 'বল কী নাম ঠিক করেছিস।'

'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল…'

'না, ওটা না অন্য নাম বল।'

'গণস্বাস্থ্য…'

'হ্যাঁ, জনস্বাস্থ্য না গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, এই নামে হাসপাতাল কর।'

সেদিনের কথা উল্লেখ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, 'আমিও গণস্বাস্থ্যই বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধু শুনেছিলেন জনস্বাস্থ্য।'

একজন রিকশাওয়ালা যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী | ছবি: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য সাভারে ৩০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে দিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে সাভারে তাঁবুতে যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যাত্রা শুরু করেছিল, তা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে, ছড়িয়েছে দেশের আরও বিভিন্ন অঞ্চলে। ঢাকায় গড়ে তুলেছেন গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। কিন্তু ভুলে যাননি সেই গরিব রিকশাচালকদের কথা। গ্রাম থেকে নগর, সর্বত্র গরিবের নির্ভরতার নাম হয়ে উঠেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

২.
মানুষের প্রতি, বিশেষ করে গরিব মানুষের প্রতি অবিশ্বাস্য রকমের সংবেদনশীল ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার মনোজগতকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। ছেঁড়া শার্ট রিপু করে কাটিয়ে গেছেন জীবন।

একদিন হাসতে হাসতে জানতে চেয়েছিলাম, 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কত টাকার সম্পদ আছে?'

'হবে কয়েক হাজার কোটি টাকার,' নির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন।

বললাম, 'কখনো মনে হয় না যে এত অর্থ-সম্পদ, অথচ কিছুই আপনার না। আপনি, আপনার স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন কেউ এর মালিক না। ভেবে খারাপ লাগে না?'

আবারও হাসতে হাসতে বললেন, 'না, আমি অর্থ-সম্পদ দিয়ে কী করব? আমার দরকার নাই তো।'

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ডাক্তারি পড়তে লন্ডন গিয়েছিলেন। সেখানে এক অর্থে রাজকীয় জীবনযাপনই করতেন। ডাক্তারি পাস করে লন্ডনে থেকে যাওয়ার বা পৃথিবীর যেকোনো উন্নত দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ ছিল। তা না করে ফাইনাল পরীক্ষার কয়েকদিন আগে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকেই নিজের পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললেন। পরীক্ষা দিলেন না। ট্রাভেল পারমিট নিয়ে ভারতে আসার পথে সিরিয়ায় পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করতে চাইল। উড়োজাহাজের ভেতর থেকে গ্রেপ্তার করা যায় না। তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়েও ভ্রমণ করছিলেন না। বেঁচে গেলেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে গড়ে তুললেন ৪৮০ শয্যার বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। সেই হাসপাতালেরই পরিবর্তিত রূপ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য ছিল, স্বাধীন দেশের গরিব মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। সেকারণে সাভারে গিয়ে হাসপাতাল তৈরি করলেন, ঢাকায় নয়।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ।

১৯৭২ সাল থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র লেনদেন করত ব্যাংকের মাধ্যমে। নগদ লেনদেন করত না বললেই চলে। ২০২৪ সালে এসেও ঢাকা শহরে মেয়েদের সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানো দেখলে অনেকেই অবাক হন। অথচ, ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নারীদের ড্রাইভিং শিখিয়ে চাকরি দিয়েছে। ঢাকা-আরিচা সড়কে সেই সময় থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পুরনো আমলের জীপ (এসইউভি) চালাতে শুরু করে নারীরা। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রিসহ বহু পেশায় মেয়েদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে অপ্রচলিত পেশায়ও দরিদ্র নারীদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। 'নারীরা পারবে না'—এমন বাক্য ছিল না তার অভিধানে।

সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালুর প্রথম দিকেই গরিব মানুষকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ৫-১০ টাকা ফি'তে গরিব মানুষের স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা চালু করেছিলেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেক্ষাপটে সফলও হয়েছিলেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল দেশের সব গরিব মানুষ স্বাস্থ্য বীমার আওতায় থাকবে। সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, সফল হননি। হাল ছেড়ে দেননি কখনো। নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন।

১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারকে দিয়ে ওষুধ নীতি করিয়েছিলেন, যা ছিল এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের যে বিকাশ, তার পুরো কৃতিত্ব ওই ওষুধ নীতির। ওষুধ নীতির আগে দেশের ওষুধের বাজার ছিল বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। ৭০ শতাংশ ওষুধ তারা তৈরি করত। ১ হাজার ৭৮২ রকমের ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ওষুধ নীতির পর সেই আমদানি নেমে আসে ২২৫টিতে। আস্তে আস্তে যা একেবারেই কমে গেছে।

বর্তমানে দেশে চাহিদার ৯৭-৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশীয় ওষুধ শিল্পে উৎপাদিত হয়। অন্য বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ওষুধের দাম কম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন—ওষুধের দাম আরও কমানো সম্ভব, আরও কমাতে হবে। সেই সংগ্রামের অংশ হিসেবে গড়ে তুলেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ফার্মাসিউক্যালস।

যার অবদানে দেশে ওষুধ শিল্পের বিকাশ, সেই জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে স্মরণ করতে চায় না ওষুধ শিল্প মালিকরা। কারণ, তিনি ওষুধের দাম কমাতে বলতেন।

আরও মজার বিষয়, যুগান্তকারী ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন দেশের ডাক্তাররা। সেই সময় ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সদস্য পদ বাতিল করে দেয় বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন)।

একজন রিকশাওয়ালা যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার

৩.
এ কথা প্রায় কারোই অজানা নয় যে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দুটি কিডনিই অকেজো ছিল। সপ্তাহে তিনদিন কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হতো। একবার ডায়ালাইসিস করতে সময় লাগত চার ঘণ্টা।

দেশের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার করে গেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নগর হাসপাতালে। একসঙ্গে ১০০ জনের বেশি ডায়ালাইসিস নিতে পারেন। এখানেও মূল লক্ষ্য গরিব মানুষ। কম অর্থে তো বটেই, টাকা ছাড়াও গরিবের ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা আছে।

ডায়ালাইসিস নিতে নিতেই ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কাজ করতেন, কথা বলতেন।

এই লেখায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর যেসব উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি, তার প্রায় সবই বলেছিলেন ডায়ালাইসিস নিতে নিতে ২০২১ সালের ৫ মার্চ দুপুরে। তার চলে যাওয়ার দিন ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল।

'ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী শুধু মানুষের নয়, সমাজের চিকিৎসায়ও নিয়োজিত ছিলেন'—তার মৃত্যুর পর কথাটা বলেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। গরিবের বন্ধু, গরিবের ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মূল্যায়নে এরচেয়ে প্রাসঙ্গিক বাক্য আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না।

৪.
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির ডা. জাফরুল্লাহর জীবন-কর্ম নিয়ে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন। নাম 'মোহনা'। মুক্তি পায় ১৯৮২ সালে।

'সিনেমাটি আপনি দেখেছেন'—জানতে চেয়েছিলাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে। হাসতে হাসতে বললেন, 'আমি দেখিনি। বহু মানুষ আমাকে বলেছে সিনেমাটির কথা। সিনেমায় দেখানো হয়েছে, আবার আমরা বিদেশে চলে গেছি।'

'আমি তো বিদেশে চলে যাইনি। রিকশাওয়ালা আমাকে বিদেশে যেতে দেননি। রিকশাওয়ালাদের জন্যে দেশে থেকে গেছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

4h ago